Homeসাহিত্যবিয়ের কনে - রত্না চক্রবর্তী এর ছোটগল্প

বিয়ের কনে – রত্না চক্রবর্তী এর ছোটগল্প

গল্প-বিয়ের কনে
রত্না চক্রবর্তী
বিয়ে বাড়ির মজা নিয়ে একটি ছোট্ট ঘটনা শেয়ার করছি যেটা সত্যি ঘটনা। আমার মা আর ছোটমাসি মাত্র দুই বছরের ছোটবড়। হবহু না হলেও একই রকমের দেখতে। এ অনেক আগের দিনের ঘটনা। মা দিদিমার কাছে অনেকবার শোনা। তখন এত জনে জনে মেয়ে দেখতে আসত না কত্তা ব্যাক্তিরা এসে দেখে যেতেন৷ কথা বলে যেতেন। সদ্য তখন ছেলেদের মানে পাত্র’র মেয়ে দেখার চল হয়েছে।
মায়ের বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করেই রেখেছিলেন দাদামশাই। বাবাকেও নাকি আমার আধুনিকমনস্ক ঠাকুরদা সঙ্গে করে এনেছিলেন একবার মেয়ে দেখাতে। ঠাকুরদার সাথে এসে সংকোচে লজ্জায় বাবা কোনমতে আড়চোখে , মাথা নিচু করে বসে থাকা মা’র একঢাল চুল আর টুকটুকে রঙটাই দেখেছিলেন। আমার পিসির তখন সন্তানসম্ভবা ছিলেন বলে আশীর্বাদ সেরে রাখা হয়েছিল কিন্তু বিয়ের একটু দেরি ছিল।
এমন সময় হঠাৎ করে আমার ছোটমাসির বিয়ের ভালো সম্বন্ধ আসে। তাদের মাসিকে খুব পছন্দ হয়। তাঁদের বাড়ি এক অতি বৃদ্ধা দিদিশাশুড়ি ছিলেন, তাকে কোনমতে নাতবৌ দেখাতেই হবে, তাই তাঁরা আর অপেক্ষা করতে চাইলেন না। ফলে মার জন্য যে বিয়ের কেনাকাটা আয়োজন করা হয়েছিল তাই দিয়ে মাসির বিয়ে হয়ে গেল। কোন এক রাজবংশের উত্তরাধিকারী ছিলেন তারা। প্রচুর গয়নাগাটি দিয়েছিলেন তারা মাসিকে।
তার ক’মাসের মাথায় মা’র বিয়ে হয়। আমার দাদামশাইকে আমার ঠাকুরদাই বলেছিলেন “ছোটমেয়ের যখন আগে ভালো সম্বন্ধ পেয়ে গেছেন তো দিয়েই দিন। আমাদের তো বাড়িতে একটা বাচ্চা হবার ব্যাপার আছে তাই আগিয়ে আনতে পারব না কিন্তু আমিও মেয়ের বাপ কাজেই আপনার সমস্যা বুঝতে পারছি।”এবার মার বিয়ের সময় ছোটমাসিকে প্রচুর গয়নাগাটি পরিয়ে, বিয়ের বেনারসী এমনকি মাথায় ভেল দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছিলেন তার শ্বাশুড়ি।
আমার মা একটু ধীরস্থির ছিলেন, আর মাসি খুব প্রাণোচ্ছল দুরন্ত টাইপের ছিলেন। তখন তার ষোল বছর।
যেই ‘বরযাত্রী এসেছে এসেছে’ রব উঠেছে, মা ভয়ে তখন বাথরুমে গেছে আর মাসি ছুটতে ছুটতে এসেছে শাঁখ হাতে বরণ করতে। তখনো বরণডালা নিয়ে আর সব এয়োরা আসেই নি। সে এসে দাঁড়াতেই বরযাত্রীদের যারা মাকে দেখেছিলেন তারা তো হতভম্ব! সে যুগে একটা নিয়ম ছিল একমেয়েকে দেখতে এলে কাছাকাছি বয়সের অন্য অবিবাহিত মেয়েদের তাদের সামনে বার করা হতো না। কাজেই মাসীকে আমার ঠাকুরদা ছাড়া আর কেউ দেখেন নি। আসলে ঠাকুরদার মাকে খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিল তাই বিয়ের আগেও মাঝে মাঝেই আসতেন। তিনি দুইবোনকেই ভালো চিনতেন, কথা গল্প করতেন। কিন্তু এই সময় এই বাড়ির পুরোহিত কি একটা জরুরী কথা বলার জন্য ঠাকুরদাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন।
বরযাত্রীদের মধ্যে প্রথমে বিষ্ময়, তারপর গুঞ্জণ শুরু হল, তারপর আমার ঠাকুরদার এক মেজাজী দাদা প্রায় হুংকার ছাড়লেন, ” এ কি অনাছিস্টি কান্ড, এ কেমন পরিবারে বিয়ে দিচ্ছে অশোক কনে কি না বর দেখতে এসেছে ছিঃ ছিঃ, শুভদৃষ্টির আগেই বর দেখা! এ বিয়েতে আমরা নেই। ” সে যুগে বরযাত্রী মানে বিশাল সম্মানী লোক আর তারাও অনেক সময় চেষ্টা করতেন কি ভাবে কন্যাপক্ষকে অপ্রস্তুত করা যায়, নাজেহাল করা যায়। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা যারা এসেছে তারা আবার মহানন্দে বলছে , ” ওই দেখ কনে, ওই দেখ কনে এসেছে বর দেখতে। “
মাসি বেরিয়েই এমন কথা শুনে কেমন ঘাবড়ে গিয়ে বাড়ির মধ্যে দে ছুট। তখন শাঁখ উলু বাজিয়ে এয়োরা বরণডালা, কলসী নিয়ে সবে ভিতর থেকে আসছে। গন্ডগোল বেশ পেকেছে। সেই জেঠামশাই রাগত মুখে চেঁচামেচি করছেন। মামারা ছুটে এসেছে, ক্রমাগত বোঝাবার চেষ্টা করছে যে কনে নয় তাদের ছোটবোন।
আমার ঠাকুরদা খুব সজাগ আর দায়িত্বশীল মানুষ ছিলেন। হৈচৈ শুনেই তিনি পুরোহিত মশাইকে বসিয়ে রেখে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলেন। ব্যাপার বুঝে তিনি বললেন, ” না না আমি জানি সে বৌমার ছোটবোন মঞ্জু, তোমরা শান্ত হও আমি ওকে নিয়ে আসছি। “
এই বলে তিনি ভিতর থেকে মাসীকে ডেকে আনলেন, মাসী প্রথমে লজ্জায় ভয়ে আসতে চাইছিলেন না। কিন্তু মজা দেখতে আর গুজব রটাতে মানুষ খুব ভালোবাসে, বেশ কিছু মানুষ কিন্তু বিশ্বাস করে গল্প ছড়িয়েছিল কনে বৌ নিজের বর বরণ করতে এসেছিল।
যাইহোক মারও প্রচুর গয়না ছিল কিন্তু মাসির তুলনায় অনেক কম। দুইবোনকে কলাতলায় পাশাপাশি দেখে সবাই বিশ্বাস করল, খুব হাসাহাসি রঙ্গ তামাশা হল। কিন্তু মা খুব চটে ছিলেন মাসীর উপর অমন সবাইকে বাদ দিয়ে লাফিয়ে সবার আগে বর দেখতে গিয়ে কেলেংকারী বাঁধাবার জন্য। কারণ মার শ্বশুরবাড়ি আসার পরও অনেকে মাকে নিয়ে মজা করে রাগাবার জন্য বলত, ” তুমি নাকি নিজের বর নিজে বরণ করতে এসেছিলে।”
মায়ের বাপের বাড়ির দেশের দূরের পাড়ার অনেকেই এই গুজব অনেকদিন অবধি আলোচনা করত। তারা তো আর নিমন্ত্রিত ছিল না। মা অবশ্য যখন আমাদের পরে গল্প করতেন তখন বিস্তর হাসাহাসিই হত।
RELATED ARTICLES

1 COMMENT

  1. অপূর্ব লাগল কবিতাগুলি ও রচনাটি।সেই জায়গাটা, সেই সাপ, সেই আনারস ক্ষেত যেন দেখতে পেলাম মনের চোখে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments