গল্প-ভাঙন
রত্না চক্রবর্তী
ইরানি আর ঐক্যের এত নিশ্চিত সম্পর্কটা যে এভাবে ভেঙে যেতে পারে তা কেউ কল্পনাও করে নি। আর করবেই বা কি করে এমন আদর্শ জুটি মেলে কই! ইরানির মতো সুন্দরী, মিষ্ট ব্যবহার , ধনী ঘরের শিক্ষিতা,সুরুচি সম্পন্না, নমনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী মেয়ে মেলে কোথায় ! অপূর্ব গান গায় ইরানি।
আর ঐক্য সুপুরুষ, সুন্দর, ভদ্র, প্রাণবন্ত,উচ্চ শিক্ষিত, সুপ্রতিষ্ঠিত , খেলোয়াড় হিসেবে সুনাম আছে। বড় জমিদার বংশের ছেলে কিন্তু নিরহংকারী, দিলখোলা ছেলে। এক পার্টিতে ইরানির বাবা আর ঐক্যের বাবার দেখা হতেই তাদের মনে পড়ে গেল তারা ছোটবেলায় এক স্কুলে পড়তেন, খুব বন্ধু ছিলেন। পরে ইরানির দাদু বদলি হয়ে যাওয়ায় বন্ধুত্বে ছেদ পড়ে। দুই প্রতিষ্ঠিত পরিবারের বন্ধুত্ব আবার গড়ে ওঠে, ছেলে মেয়েরা পরিচিত হয়। তারপর ভালোলাগা তারপর বাবা মার মনোগত ইচ্ছা দুজনকে বেঁধে দেওয়ার। শোনা থেকেই ভালোলাগা ভালোবাসা হয়ে গেল। সবাই বলত আদর্শ জুটি। অথচ…
ওরা সবাই মিলে ঠিক করেছিল বন্ধু আর নিকট সমবয়সী ভাইবোনেদের ক’জন মিলে যাবে ওদের দেশের বাড়িতে। সেখানে মস্ত বাড়ি খালি পড়ে আছে, আলো পাখা জল সবই আছে যদিও এসি আর পাম্প নেই। তবে দেখাশোনার জন্য লোক আছে তার ফ্যামিলি নিয়ে থাকে। তারাই জল তুলে দেবে, রান্নার ব্যবস্থা করবে। ওরা দিন তিন চারেকের জন্য যাবে। খুশিই ছিল সবাই দুটো বড় বড় ঘরে ছেলেরা আর দুটো ঘরে মেয়েরা থাকবে। উভয় পরিবারের ইচ্ছা ছিল ওরা নিজেদের ভালো করে জানুক, বুঝুক একটা সীমারেখার মাঝে থেকে। চিন্তার কিছু নেই ইরানির মাসতুতো দিদি জামাইবাবু আর পিসতুতো দাদাও যাচ্ছে সঙ্গে, সবাই খুব হুল্লোড়ে। আর ঐকের তো খুড়তুতো ভাইবোন, দুই বন্ধু আছেই, তারাও খুব মজাদার। দারুণ জমবে।
ভালোই তো চলছিল, ঝিলে চান করা, জাল ফেলে মাছ ধরিয়ে খাওয়া, অন্ত্যাক্ষরী খেলা, ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলা, গান চালিয়ে নাচা… কত্ত কি! আর ইরনি আর ঐক্য একে অপরের কত গুণ যে রোজ আবিষ্কার করে নতুন ভাবে একে অপরকে চিনছিল তা ভাবা যায় না। যেমন ইরানি দারুণ ছবি আঁকে। ঐক্য দারুণ সাঁতার জানে, রাইফেল শ্যুটিং ‘এ জবরদস্ত। ইরানি একটা অনাথ আশ্রমের সাথে যুক্ত, সপ্তাহে দুদিন সেখানে যায় কাজ করে। ইরানির দিদি আর ঐক্যের বন্ধুরাই এইসব গুণাবলির প্রচারক। কিন্তু এতেই গন্ডগোল হল। তৃতীয় দিনে ঐক্য ইরানি ছাদে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। এখানে ছাদে দাঁড়ালে কতদূর অবধি দেখা যায়। দূরে ঝিলের জলে আলোর ঝিকিমিকি। একজোড়া খয়েরী রঙের পাখি, লাল চুনীর মতো চোখ একটা মস্ত ঝাঁকড়া গাছের ডালে বসে একে অপরকে প্রেম নিবেদনে ব্যস্ত। লাজুক আবিষ্ঠমুখে সে দিকে তাকিয়ে ছিল দুজনে। এমনসময় ঐক্যের বন্ধু অগ্নিপ্রভ এসে হাজির বন্দুক হাতে। ওর শিকারের ইচ্ছা। একদিনও সে সুযোগ হয় নি অবশ্য। ওদের গল্প শুরু হল। একসময় বন্ধুর যোগ্যতা প্রমাণ করতে অগ্নি বলল ” ওর মতো হাতের টিপ আমাদের শ্যুটিং ক্লাবের কারোই নেই। ও উড়ন্ত পাখিকে এক নিমেষে ফেলে দিতে পারে। “
ইরানি কেমন ফ্যালকা মুখে বলল “যাহ! কেন? “
অগ্নি উৎসাহিত হয়ে বলল ” বিশ্বাস হল না, এক্ষুনি প্রমাণ করে দিচ্ছি। এই ধর তো, নিশানা দেখাচ্ছি ওই উঁচু ডালের পাখিদুটোর বাঁদিকেরটাকে এম কর। ” ইরানি বলল ” না না কোন দরকার নেই, আমি এমনই বিশ্বাস করছি। “
ঐক্য এক ঝলক হাসল ওর দিকে তাকিয়ে তারপর… দুটো আর্তচিৎকার, একটা পাখির অন্যটা ইরানির।
ব্রেকআপটা হয়েই গেল। অনেক বুঝিয়েছিল ইরানির জামাইবাবু, এটা একটা গেম, ওদের জমিদারি বংশ, শিকার শৌর্যের প্রতীক। মানতে পারেনি ইরানি, তার চোখের সামনে ভাসছিল সেই একটু আগের প্রেমরত পাখি জোড়া। সম্পর্কটা ভেঙেই গেল। একটা পাখির ঝরা পালক ও রক্ত মুছে দিল মাঝের দিনগুলো।।