Homeসাহিত্যকবি আফতাব আলোক এবং একটি উপহার - তন্ময় ইমরান এর ছোটগল্প

কবি আফতাব আলোক এবং একটি উপহার – তন্ময় ইমরান এর ছোটগল্প

কবি আফতাব আলোক এবং একটি উপহার
তন্ময় ইমরান
প্রায় অসাধ্য একটা কাজ করে ফেললেন আফতাব আলোক। সাড়ে তিন যুগ আগের প্রেমিকা মৌমিতা রহমানের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে পাঁচ লাইনের একটা কবিতা লিখে ফেললেন। দীর্ঘ ষাট বছরে যিনি মাথায় প্রচুর ভাব ধরেও এক লাইনও কবিতা লিখতে পারেননি, তিনিই কিনা মৌমিতার সম্বর্ধনায় যোগ দিতে এসে এককোণে বসে কবিতা লিখে ফেললেন! কবি হিসেবে মৌমিতা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাচ্ছে দুদিন পর। সে উপলক্ষে আফতাব আলোক-কে এ অনুষ্ঠানে দাওয়াত। পুরনো প্রচুর কবি বন্ধু-বান্ধব এসেছেন। এরমধ্যে একমাত্র আফতাবই আজকের দিনটি ছাড়া কবিতা লিখেননি পুরো জীবনে।
অথচ মৌমিতার সঙ্গে এবং বাকি কবি বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কবি হিসেবেই তার প্রথম পরিচয়। তিনি দুর্দান্ত কবিতার ছন্দ বোঝেন, ভুল ধরতে পারেন এবং সমালোচনাও করতে পারেন। দেশ-বিদেশের অনেক অখ্যাত কবিরও কবিতা এক সময় মুখস্ত বলতে পারতেন আফতাব। তার সমসাময়িক কবি বন্ধুবান্ধবরা তারচে পড়ায় এবং জানায় অনেক পিছিয়ে ছিলেন। এমনকি আফতাবের ভাষা এবং শব্দ চয়নও ছিল যে কারও চেয়ে ভালো। সেই আফতাবকে নিয়ে একবার কবি বন্ধুরা খুব হাসিঠাট্টা করলো। কেউ কেউ বললো- তুমি তো দাবি করো লিখলে অনেক ভালো লিখতে। একটা লিখে দেখাও। আফতাব লিখে দেখাতে পারেননি।
সাড়ে তিন যুগ আগে মৌমিতার সঙ্গে প্রেমটা তার ছয়মাস টিকেছিল। কেননা, ষষ্ঠ মাসে আফতাব যখন মৌমিতা ও অন্য কবি বন্ধুদের সঙ্গে পাহাড়ে বেড়াতে যান, তখন মৌমিতাও তাকে চেপে ধরেছিলেন- নিজের লেখা কবিতা অন্তত দুই লাইন শোনাতে। বলেছিলেন- জীবনানন্দ এতো নিভৃতচারী ছিলেন, তাও তো জীবদ্দশায় কত কবিতা লিখেছেন, ছেপেছেন। তুমি একটা শোনাও বা লিখে দেখাও! ওদের মুখ বন্ধ করে দাও।
পাহাড়ি সৌন্দর্যে আফতাবের মনে হরহর করে কবিতার লাইন ঘোরাফেরা করছিল। কিন্তু তিনি বলতে পারছিলেন না, লিখতে তো একেবারেই নয়। সে ট্যুরে আফতাব বাকিদের সঙ্গে ঘুরতেও পারেননি। একটু পরপরই তার টয়লেট চেপেছে। হ্যা এটাই তার সমস্যা ছিল- যখনই তার মাথায় কবিতার লাইন আসতো, তখনই তার পায়খানা চাপতো। পাহাড়ি সৌন্দর্য এমনই, যে তার ক্ষণে কবিতা এসেছে, ফলে টয়লেটের ভয়ে এক পর্যায়ে তিনি আর রেস্ট হাউস থেকেই বের হননি। মৌমিতা ঘুরেছে অন্য কবি বন্ধুদের সঙ্গে।
ছোটবেলা থেকে এ কারণে তার কখনো কবিতা লেখাই হয়নি। ছুটে যেতে হয়েছে কোষ্ঠ পরিষ্কারের ডাকে। আর তখন তো কমোড ছিল না, মোবাইলও ছিল না- হাঁটু গেড়ে বসে হাগতে হাগতে কবিতা লেখা যায়! একথা তো আর মৌমিতা আর অন্য কবি বন্ধুদের বলা যায় না।
সেবার তাদের প্রেমটা ভেঙে গেলে আফতাব আলোক, ঢাকায় এসে চিকিৎসক দেখান। সাড়ে তিন যুগ আগের চিকিৎসকরা নানাভাবে তার খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। কেউ বলে দুধ খাবেন না, কেউ বলে রসুন, কেউ কেউ তো ভাত খাওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ দিলেন। তাতে কিছুই হয়নি। আফতাবের মাথায় কবিতার লাইন এলেই- পেটে চাপ বাড়ে, বসতে হয় দুই পায়ে ভর দিয়ে প্যানে। যে হাতে বদনা ধরতে হয়, ওই একই সময়ে একই হাতে তো কবিতা লেখা যায় না!
অবশেষে আফতাব আলোক কবিতা জগত থেকে সরে গেলেন। এমনকি কবি হিসেবে যে নাম তিনি নিজে রেখেছিলেন, আফতাব আলোক- সেখান থেকে আবার নিজের পিতৃপ্রদত্ত নাম- তালেবুর রহমান আফতাব এ ফেরত গেলেন। পেশাগত জীবনে তিনি বেশ সফল; তবে মৌমিতার বিরহে, নাকি কবিতা না লিখতে পারার কষ্টে আজীবন বিয়ে না করেই থাকলেন।
ওদিকে মৌমিতা এবং তার কবি বন্ধুরা আফতাবকে সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে ডেকেছিলেন এ কারণে যে, আফতাবের হাত ধরেই মৌমিতা চৌধুরীর কবিতা শুরু। তাকে কবি মহলে পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছিলেন আফতাব। আজ ৩৪ বছর পরে হয়তো সে কথাই সবাই স্মরণ করতে চেয়েছেন। কিংবা এমনও হতে পারে আফতাবকে আরেকটু খোঁচানোর লোভ ছাড়তে পারেননি তার সেসময়ের সার্কেল।
কবিতা ছেড়ে দিয়ে আফতাব ভালোই করেছিলেন পেশায়। ব্যাংকার হিসেবে তিনি শীর্ষস্থানে পৌঁছে গিয়েছেন।
পাঁচ বছর আগে যখন চিকিৎসার জন্য বাম্রুনগ্রাদে গিয়েছিলেন তখন এক নামকরা চিকিৎসকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। সেই চিকিৎসক আবার কথায় কথায় কবিতা আওড়ান। প্রায় চর্চা নেই, তবু আফতাব তার সঙ্গে তাল মেলাতেন। চিকিৎসক খুব অবাক হয়ে আফতাবকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন- তুমি নিশ্চয়ই তোমাদের দেশের বড় কবি-সাহিত্যিক কিংবা সাহিত্য সমালোচকদের একজন।
খুব খাতির হয়ে যাওয়ায়, সেই চিকিৎসকের কাছেই খুলে বলেছিলেন তার সমস্যা- কবিতা মাথায় আসলেই তার পায়খানা চাপতো। তাই লিখতে পারেননি পুরোটা জীবন। চিকিৎসা বিত্তান্তও খুলে বলেছিলেন আফতাব।
চিকিৎসক হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘ডেয়ার অ্যাফট্যাব’ তোমার সমস্যা কখনো পেটে ছিল না। ছিল মস্তিষ্কে। আসলে কবিতার লাইন তোমার ভেতর মানসিক চাপ তৈরি করতো। তুমি কবিতাকে এতোই ভালবাসতে যে মানসিক চাপের গভীরতাও খুব বেশি ছিল। ফলে তোমার পাকস্থলিতে সেরোটনিন নামের একটি কেমিকেল তৈরি হতো। আর সেটাই পুরো কোলন (মলাশয়) জুড়ে একটি ঝাঁকুনি দিত। ফলে কবিতা মাথায় এলেই তোমার পায়খানা চাপতো এবং বের হয়ে যে লাইনগুলো লিখবে সেগুলো আর মস্তিষ্ক পরে স্মরণই করতে চাইতো না। এড়িয়ে যেত। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এটি ‘ইরিটেবল বোউল সিনড্রোম’ বা ‘আইবিএস’ নামে পরিচিত।
ছেষট্টি বছর বয়সী আফতাব আলোক যখন মঞ্চে উঠে পাঁচ লাইনের কবিতাটিকেই তার বক্তৃতা হিসেবে আবৃত্তি করলেন- তার কবি বন্ধুরা দাঁড়িয়ে তাকে হাততালি দিলেন। জীবনের প্রথম লিখিত কবিতা আফতাবের। মৌমিতা এগিয়ে এসে তার হাত ধরলো। তার চোখে পানি। সামনের সারির বেশ কয়েকজনের চোখেও পানি।
তারা কি জানেন, আফতাবের কোলন ক্যান্সার শেষ স্টেজে! তারা কি জানেন এতো বড় অসুখ মলাশয়ে বাসা বেঁধেছে বলেই কবিতা লিখতে গিয়ে আজ তার আর পায়খানা চাপলো না! নো স্ট্রেস পুপ। হয়তো, হয়তো না। তবু জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা শেষ পর্যন্ত তো আফতাব উপহার দিতে পারলেন- পৃথিবীর মায়া কাটানোর জন্য এ প্রাপ্তিই বা কম কিসে!
(আমার গল্পের পাঠক আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। এটা একটা ভালো লক্ষণ। চাপহীনভাবে লেখা যায়। নো স্ট্রেস পুপ অ্যাট অল।)
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments