বাসর রাত থেকেই সমস্যা – তন্ময় ইমরান (সাইকোলজিক্যাল ছোটগল্প)
বাসর রাতে আলরিন দুই বার অজ্ঞান হলো। প্রথমবার অজ্ঞান হলো, যখন সে আর আজাদ পোশাক পাল্টে একটা ‘সফট আদরে’র প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন আর কি! এমনিতে সারাদিনের স্ট্রেসের কারণে খুব বেশিক্ষণ কিছু করার ইচ্ছে তাদের ছিলনা বটে, তবে একেবারেই কিছু না করলে বাসর রাত ব্যাপারটা তো আর থাকে না!
দুজনেই পোশাক পাল্টে ফ্রি হচ্ছিল। আলরিন রোমান্টিক দৃষ্টিতে আজাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। আজাদ লুঙির গিঁট বেঁধে তার দিকে এগিয়ে আসছিল- এসময়ই হঠাৎ আলরিনের শরীর কাঁপতে থাকে। চোখ বিস্ফোরিত হয় এবং সে অজ্ঞান হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। আজাদ কিছুই বুঝতে পারে না। সে হতভম্ব হয়ে যায়। বাসর রাতে বউ নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ির ব্যাপারটা নিয়েও বিচলিত হয়। লোকে যদি শোনে আলরিন অজ্ঞান হয়ে গেছে তাহলে অশ্লীল কিছু মানে করবে। এমনকি বন্ধুবান্ধবকেও তো বলা যাবে না। সারাজীবন পচাবে। এসব ভাবতে ভাবতেই আজাদ আবার টি-শার্ট এবং ট্রাউজারও পরে নেয় আলরিনকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে বলে।
এসময় আলরিনের জ্ঞান ফেরে। স্ট্রেসের কারণেই আলরিন অজ্ঞান হয়েছিল। তারা সিদ্ধান্ত নেয় আজ রাতে সেক্স-টেক্স বাদ, বরং গল্প করেই কাটাবে। অবশ্য গল্প বলতে কেবল বিয়ের আসরে কে কী বললো, কে কী পোশাক পরে এসেছিল- সেসব নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বললো।
আলরিনের সঙ্গে আজাদের এটা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। দুইজনের মধ্যে আলাপচারিতার শুরু মাত্র মাস খানেক আগে। ‘আলরিন’ নামের একটি মেয়ে আজাদের বাবার বন্ধু এবং সে পারিবারিক পছন্দে বিয়ে করতে চায় শুনে আজাদ আগ্রহী হয়েছিল। আলরিন নামটাই তার পছন্দ হয়েছিল অনেক। গুগল ঘেঁটে দেখেছিল খাঁটি সংস্কৃত শব্দ, যার অর্থ ঈশ্বরের উপহার!
তাদের দুইজনের প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল, সেদিন আজাদ বুঝতে পেরেছিল নামের মতোই আলরিন সত্যিকার অর্থে ঈশ্বরের উপহার। ছাঁচে ফেলা ব্যক্তিত্ব, চেহারা এবং ফিগার। আলরিনেরও আজাদকে খুব পছন্দ হয়েছিল। কেননা, ছেলেটি রীতিমত তার নাম নিয়ে গবেষণা করে এসেছিল। যেমন- তার নামের নিউমারলজি অনুযায়ী সংখ্যা ৯। এ সংখ্যার প্রভাব যাদের উপর রয়েছে তারা খুব আদর্শিক হয়, প্রিয় মানুষের প্রতি ডেডিকেটেড থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি। যে ছেলে তার নাম নিয়েই এতো গবেষণা করতে পারে, সে নিশ্চয়ই জীবনসঙ্গী হিসেবে অনেক মনোযোগ দেবে- এটাই ছিল আলরিনের ভালো লাগার কারণ।
বাসর রাতে একমাসে ঘটে যাওয়া এসব হাবিজাবি নিয়ে আলাপ করতে করতেই স্বামী-স্ত্রীর প্রথম আদরটা টুকুস করে হয়ে গেল। আলরিনই চাচ্ছিল, আজাদ বরং ভয় পাচ্ছিল। পরে সায় দিল।
এরপর আলরিন আবার দ্বিতীয়বার অজ্ঞান হলো, যখন ফ্রেশ হয়ে তারা দুইজনেই ঘুমাতে যাচ্ছিল তখন। আজাদ টয়লেট থেকে বেরিয়ে দেখলো, আলরিন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তারপর আগেরবারের মতো কাঁপলো এবং অজ্ঞান হয়ে গেল। আবার সে প্রস্তুত হলো, আলরিনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য, এবং আবার আলরিনের জ্ঞান ফিরলো। এরপর ওই অবস্থাতেই সারারাতের ক্লান্তি নিয়ে আলরিন ঘুমিয়ে পড়লো।
পরের রাতে আলরিন বললো- তুমি রাতে লুঙি পরে শুবে না। আমার সমস্যা হয়।
আজাদ একটু অবাক হয়ে বললো- কেন? আলরিন বললো- আহা আমি বলেছি তো সমস্যা হয়।
আজাদ কিছু না বলে, লুঙি ছেড়ে পায়জামা পরে শুলো এবং তার ঘুম এলো না পুরো রাত। তৃতীয়দিনও তাই। ফলে আজাদ আর আলরিনের মধ্যে একটা ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হলো। কেননা ঘুম না এলে তো সারাদিন মেজাজটা খিটখিটে থাকে। আবার বাবা-মা, ভাই-ভাবি আছে বলে, সে আর আলরিন আলাদাও শুতে পারছে না। আলরিনের একটাই কথা, লুঙি পরে সে আজাদকে রুমে অ্যালাউ করবে না।
সপ্তাহ খানেকের মাথায় আলরিনদের গ্রামের বাড়িতে আজাদের দাওয়াত পড়লো। দুজনে সেখানে গেল বটে, কিন্তু আজাদ রাতে থাকলো না। লং ড্রাইভ করে ফিরে আসলো- অফিসের অজুহাতে। আসার সময় আলরিনকেও মিথ্যা বললো, অফিসের বস ফোন করেছিলেন। কাল একটা জরুরী মিটিংয়ে জুমে বসতে হবে। কানাডার হেড অফিস থেকে শ্বেতাঙ্গ বস যোগ দিবেন। গ্রামে তো নেটওয়ার্ক আসে যায়। তাই ঢাকা ফিরতে হচ্ছে।
বাড়ি এসে আজাদ দুইদিন লুঙি পরে ঘুমালো। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় ঠিক করলো- আলরিনকে চিকিৎসক দেখাবে, এটা অবশ্যই মানসিক রোগ।
দুই
আলরিনকে ফোনে চিকিৎসকের কথা বলতেই সে জানালো- তাকে ইতিমধ্যে চিকিৎসক দেখানো হয়েছে। রোগটার নামও সে বলে দিল- ভেস্টিফোবিয়া। বিশেষ ধরনের পোশাক ভীতি। তার রয়েছে লুঙিভীতি। চিকিৎসক এ রোগের কারণ উদঘাটন করতে পারেননি এবং সেজন্য চিকিৎসাও হয়নি ঠিক মতো। কাজেই এ থেকে প্রতিকারের দুইটা উপায়- আজাদকে লুঙি ছাড়া অন্য যেকোনও পোশাকে ঘুমাতে হবে। অথবা আলরিনের সঙ্গে রাতে অন্তত আলাদা থাকতে হবে।
আজাদ সত্যিকার অর্থেই বিপদে পড়েছিল। কেননা, মানসিক রোগ বিষয়টাই এমন জটিল, যে দেখা গেল লুঙি সহ্য করতে রোগীকে জোর করা হলে, পায়জামা বা প্যান্ট নিয়ে তার আবার ‘ভেস্টিফোবিয়া’ টাইপ রোগ হয়ে গেল। তখন আবার লুঙি পরে বাসা থেকে বের হতে হবে!
বেশ কয়েকদিন পরে আলরিনকে গ্রাম থেকে ফিরিয়ে আনতে গেল আজাদ। সে আগেরবার খেয়াল করেনি, এবার দেখলো- আলরিনদের ঢাকার বাসার সবাই তো বটেই, গ্রামের বাড়িরও সবাই জানেন যে আলরিনের লুঙিভীতি আছে। তারা এ কয়দিন সবাই পাজামা পরে ঘুরেছে। আলরিন গেলে তারা এ নিয়মে চলেন। ঢাকায় তার পরিবারের পুরুষরা কখনো লুঙি ছাড়া পরেননি। আজাদ আরও জানতে পারলো- লং স্কার্ট পরে এমন কোনও বান্ধবী আলরিনের কখনো হয়নি! আলরিনের মতে, “লং স্কার্ট ইজ ইকাল্টু ইলাস্টিক পরা লুঙি”।
তিন.
ঢাকায় ফিরে আজাদ গেল তার এক সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধুর বাড়ি। বন্ধু সব শুনে বললো- সমস্যা কেবল ভাবির নয়, তোরও আছে। তোর রোগটাকে তুলনা করা যায়- সার্কাডিয়ান স্লিপ ডিজঅর্ডারের সঙ্গে।
আজাদকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বন্ধু হাসতে হাসতে বললো- ব্যাপারটা খুব ইজি। আমাদের মাথার মধ্যে একটা ঘড়ি কাজ করে, মানে তুই-আমি সব প্রাণী কখন খাবে, কখন ঘুমাবে, কিভাবে খাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ঘুমের ক্ষেত্রে এ দেহঘড়ি বা সার্কাডিয়ান ঘড়িটা আরও সেনসিটিভ। অন্য অনেককিছুর সাথে কারও কারও ক্ষেত্রে সার্কাডিয়ান ক্লকে তার রাতের ঘুমের পোশাকও বড় ভূমিকা রাখে। মানে তুই যে ধরনের পোশাক পরে ঘুমাতে অভ্যস্ত সেই ধরনের পোশাক না পরলে রাতে ঘুম হারাম হয়ে যাবে। তখন অন্যান্য সমস্যাও দেখা দিবে। আমি তোকে বরং বলবো ন্যাংটো হয়ে ঘুমা। এতে তোর ঘুমও হবে, ভাবিরটাও।
প্রথম প্রথম ন্যাংটো হয়ে ঘুমাতে অস্বস্তি লাগলেও আজাদ বন্ধুর পরামর্শ মেনে নিয়েছিল। এতে কাজও হয়েছিল। কিন্তু রাতের বেলা খালি ঘুমানোর সময় ন্যাংটো থাকতে হতো বলে তেমন সমস্যা ছিল না । কিন্তু কয়েকদিন পরেই আজাদের মাথায় আসলো- যদি বাচ্চা-কাচ্চা হয়, তখন কী হবে! এর উপায়টা অবশ্য আলরিনই বাতলে দিয়েছিল। ঘুমিয়ে পড়ার আগে সে চোখে পট্টি বেঁধে নিবে এবং তারপর আজাদ লুঙি পরে ঘুমাবে।
বিয়ের অনেকদিন পরে, আলরিন-আজাদের প্রথম কন্যাশিশুর বয়স যখন বছর পাঁচেক, তখন কথায় কথায় আজাদ জানলো ছোট্ট একটি গল্প। আলরিনের বয়সও যখন বছর পাঁচেক ছিল তখন সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে একবার দীর্ঘ সময় ছুটি কাটাতে গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে আলরিনের একটা গলার চেইন চুরি হয়। কিশোর বয়সী এক কাজের ছেলে ছিল, তাদের গ্রামের বাড়িতে- গরুটরু দেখতো। চেইনটা সেই নিয়েছিল। যদিও আলরিনকে সে খুব আদর করতো। কোলে কোলে রাখতো। কোনও এক ফাঁকে সেটা গলা থেকে খুলে নিয়েছিল। পরে সেটা তার ট্রাঙ্কে পাওয়া যায়।
চুরিটা সে কেন করেছিল কে জানে, কিন্তু ধরা পড়ে খুবই অনুতপ্ত হলো। তাকে চলে যেতে বলা হলো। ছেলেটা সেই রাতে তার থাকার ঘরে ফাঁস দিয়েছিল। এ স্মৃতি যদিও আলরিনের মনে খুব আবছা। কিন্তু শোনার সঙ্গে সঙ্গে আজাদ বুঝতে পারলো, আলরিনের লুঙিজনিত সমস্যার কারণ। খুব সম্ভবত ছেলেটা লুঙি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছিল, যেটি আলরিনের স্মৃতির অবচেতনে রয়ে গেছে।
আজাদের খুবই আপসোস হলো। না, ওই আত্মহত্যা করা কিশোরের জন্য নয়, বরং আলরিনের অসুখের কারণটা জানতে না পেরে দীর্ঘদিন প্রিয় পোশাক লুঙিতে না ঘুমানোর জন্য।