Homeবিনোদননাটোরের কিংবদন্তি অভিনেত্রী অনিমা‘দে টুনি- মাহাবুব খন্দকার

নাটোরের কিংবদন্তি অভিনেত্রী অনিমা‘দে টুনি- মাহাবুব খন্দকার

নাটোরের কিংবদন্তি অভিনেত্রী অনিমা‘দে টুনি- মাহাবুব খন্দকার

‘ও সোনা তোরে কতদিন পরে দেখলাম ! মানিক আমার ! আমি এখন খুব ভাল আছি ! থাকা খাওয়ার কোন অসুবিধা এখন আর নেই ! রাজশাহী বেতার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিয়মিত অভিনয় করছি। সম্মানীয় জুটছে ভালোই।

তোরে আমি কি খাওয়াবো বাবা ? তোকে কিছু খাওয়াতে পারলে, আমার আত্মাটা শান্তি পাবে !’ এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন আর কপালে চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরলেন, নাটোরের সেই কিংবদন্তি অভিনেত্রী ও কণ্ঠশিল্পী অনিমা’দে টুনি।

আজ ২২শে ডিসেম্বর ২০২১ খ্রিস্টাব্দ রোজ বুধবার বেলা আনুমানিক ১২ টার সময় নাটোর পৌরসভা ২ নং ওয়ার্ডের রসুলের মোড় এলাকায় দেখা হয় তার সাথে। প্রায় তিনটি বছর পরে। তার মুখমন্ডলে সুখের একটি ছাপ স্পষ্ট ভাসছিল। আনন্দিত এবং উৎফুল্ল ছিল বদন।

২০১৭ খ্রিস্টাব্দের সম্ভবত ১১ই অক্টোবর কোন একটি বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির, নাটোর জেলা শাখার, সাধারণ সম্পাদক, ভবেশ চক্রবর্তী ভক্ত’দার সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে তিনি অনুরোধ করেছিলেন একটি নারীকে নিয়ে প্রতিবেদনের জন্য।

২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর রোজ সোমবার নাটোর থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক বারনই’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় সেই নারীকে নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি সাপ্তাহিক বারনই পত্রিকার সম্মানিত সম্পাদক, জনাব বিপ্লব কুমার পাল’ এর প্রতি। প্রকাশিত প্রতিবেদন-

অনিমা দে’র দিন কাটে খাবারের চিন্তায়

যাত্রা মঞ্চে একসময় সমাদৃত ছিলেন অনিমা দে টুনি। দরাজ অভিনয়ে মানুষকে আন্দোলিত করেছেন। কিন্তু যাত্রা মঞ্চের আলো নেভার সঙ্গে নিভেছে যাত্রা শিল্পের স্বচ্ছলতার আলো। অনিমা দে টুনির জন্ম নড়াইল জেলার কালিয়া থানার গাজীর হাটে ১৯৫৯ সালে।

অভিনয়ের জন্য পরিবার নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থেকেছেন। শেষ পর্যন্ত নাটোরকে ভাল লাগে। ১৯৭৮ সালে স্বামী সন্তান নিয়ে স্থায়ী হন নাটোরে। যাত্রা অভিনয় শিল্পী অনিমা মাত্র সাত বছর বয়স থেকে শুরু করেন তার অভিনয় জীবন। তিনি একজন সংগীত শিল্পীও।

টুনির অভিনয়ের হাতে খড়ি হয় বাবা ওস্তাদ যোগেশ মাষ্টারের কাছে। ওস্তাদ যোগেশ মাষ্টারের কাছে তৈরি হয়েছেন তৎকালিন সময়ের দেশের সেরা অভিনয় শিল্পী ও কণ্ঠশিল্পীরা। এই গুণি শিল্পী অভিনয় করেছেন দেড় শতাধিক যাত্রা পালায়। খ্যাতির চুড়ায় উঠেছিলেন যাত্রার মাধ্যমে।

তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য যাত্রাপালা-লালন ফকির, নবাব সিরাজ উদ দৌলা, দ্রৌপদির বস্ত্রহরণ, আনার কলি, মায়ের চোখে জল, রামপ্রসাদ, মেঘে ঢাকা তারাসহ আরও অনেক যাত্রায়। দীর্ঘ ৩৬ বছর তিনি নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

অভিনয় করেছেন দেশের সেরা অভিনেতা অভিনেত্রীর সাথে। তার মধ্যে উল্লেখ্য আনোয়ার হোসেন, রবিউল, টেলিসামাদ, আনোয়ারাসহ আরো অনেকের সাথে। নবাব সিরাজ উদ দৌলা যাত্রাপালায় আলেয়ার চরিত্রে অভিনয় করে মানিকগঞ্জ জেলা থেকে পেয়েছিলেন সোনার মেডেল।

১৯৭১ সালে ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখান থেকে তারা সপরিবারে আগরতলা হয়ে ত্রিপুরায় যান। সেখানে শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। আগরতলার হরিজন কানাই মহন্ত ও গোবিন্দ ধরের উদ্যোগে সেখানকার দার্জিলিং গুখারহাট, রায়গঞ্জ, শিলচর, কুমারঘাট, গোহাটি বিভিন্ন এলাকায় শরণার্থীর সাহাযার্থে ৯ মাস অভিনয় করেন।

দর্শকদের মনের খোরাক পূরণ করে নিজের অভিনয় জীবনকে আলোকিত করা এই গুণি শিল্পীর জীবনে দুঃসহ স্মৃতিও কম নয়। জীবনে পেয়েছেন দুটি সন্তান হারানোর কষ্ট। প্রায় ৩৮ বছর আগে তার বড় ছেলে জটিল রোগে আক্রান্ত হয়, সন্তানের চিকিৎসার জন্য জমানো অর্থ ব্যয় করেন তবুও সে সন্তানকে তিনি বাঁচাতে পারেননি।

প্রায় ৯ বছর আগে তার মেজো ছেলের হিমোফাইলিয়া হয়। মাদ্রাজে চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রচুর টাকা ব্যয় করেন। তিনি মেজো ছেলেকেউ বাঁচাতে পারেননি। তার স্বামী দিলিপ কুমার দে যাত্রা শিল্পী ছিলেন। ৩ বছর আগে রাস্তা পারাপারের সময় একটি মটর সাইকেলের ধাক্কায় অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন।

দুর্ঘটনার পর তিনি ২ মাস অজ্ঞান ছিলেন। ছোট ছেলে মেধাবী শিক্ষার্থী। তিনিও ৫ বছর আগে মটর সাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হন। অনিমা নাটোর শহরের পশ্চিম আলাইপুরে বসবাস করেন একটি জীর্ণ শীর্ণ ঘর ভাড়া করে। ভাড়া বাবদ দিতে হয় প্রতিমাসে ১১০০/- টাকা।

প্রতিটি সকালে যখন ভাঙ্গা ঘরে আলো ঢুকে তখন চিন্তা করেন আজ কি খাবেন? মন্দিরে মন্দিরে ঘুরেন অসুস্থ স্বামী আর সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে। কখনো বা মন্দিরে যেয়ে র্কীর্ত্তন করেন। এক মুঠো খাবারের আশায় দিন কাটে তাঁর।

প্রতিবেদন প্রকাশের পর জেলা প্রশাসক’এর পক্ষ থেকে খাদ্য, বস্ত্র এবং নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। জেলা শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে শিল্পী হিসেবে সম্মাননা প্রদান করা হয়। সুরেলা কন্ঠে তার গান শুনে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক সহযোগিতা করেন। এছাড়াও অসচ্ছল সংস্কৃতি শিল্পীর ভাতার তালিকায় তার নাম যুক্ত করা হয়।

ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব শাহিনা খাতুন নাটোর। আরো কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি জনাব ড. চিত্রলেখা নাজনীন সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) নাটোর। জনাব শাহাদাৎ হোসেন, সাবেক জেলা কালচারাল অফিসার, নাটোর।

নাটোরের কিংবদন্তি অভিনেত্রী ও কণ্ঠশিল্পী অনিমা‘দে টুনির সন্ধানে, যেদিন খুজতে খুজতে তার বাড়িতে পৌঁছে ছিলাম, ছেঁড়া একটি কাপড় পড়ে, মলিনবদনে তিনি বলেছিল- ‘আমি অনিমা‘দে টুনি। সেইদিন তার জীবনের গল্প শুনে এবং স্বচক্ষে দেখে, ভীষণ কান্না পেয়েছিল ! আজ প্রাণ খুলে হাসলাম। এই তৃপ্ততা আমার নয়। সোনার বাংলাদেশের।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments