HomeUncategorized‘যেভাবে লেখা হলো বাবু মণ্ডলের জীবনবৃত্তান্ত’ - মোজাফফর হোসেনের রম্য গল্প

‘যেভাবে লেখা হলো বাবু মণ্ডলের জীবনবৃত্তান্ত’ – মোজাফফর হোসেনের রম্য গল্প

‘যেভাবে লেখা হলো বাবু মণ্ডলের জীবনবৃত্তান্ত’
মোজাফফর হোসেন

‘চলে গেলেন কবি বাবু মণ্ডল। তিনি এই সময়ের আলোচিত লেখক ছিলেন। তার লেখায় ফুটে উঠেছে দেশের নিম্ববর্গীয় জনগোষ্ঠীর কথা। তিনি ছিলেন জনদরদী কবি। মানুষই তার লেখার মূল উপজীব্য ও অনুপ্রেরণা। নিভৃতচারী এ কবির মৃত্যুশোকে দেশের সাহিত্যমহল আজ শোকাহত…’— কথাগুলো একটি দৈনিকে পড়েছিলাম। কিছু দিন আগের ঘটনা। বাবু মণ্ডলের কোনো লেখাই আমার পড়া হয়ে ওঠেনি। ভাল কবি হলেও দেশের মেইনস্ট্রিম সাহিত্যে ততটা পরিচিত ছিলেন না। মৃত্যুর পর কিভাবে যেন তাঁকে নিয়ে হইচই পড়ে গেল। রাজধানীর প্রকাশকরা এখন তাঁর বই প্রকাশের আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তাদের ধারণা হয়তো মিডিয়া ও ফেসবুকীয় এই আলোচনার সূত্র ধরে কিছুটা ব্যবসা হতে পারে। যে-সকল লেখক তাঁর লেখায় ভুল-ত্রুটি উদ্ধার করে সমালোচনা করতেন বলে শুনেছি তাঁরাও এখন স্তুতি করছেন। এক সময় ফ্রিল্যান্স প্রুফরিডারের কাজ করার দরুন ওইসব সমালোচনার কিছু কিছু আমাকে পড়তে হয়েছে। দু-একটি সাহিত্যের বই যে আমি জীবনে পড়িনি তা নয়। কিন্তু বাবু মণ্ডলের কবিতা পড়ার সুযোগ ও সময় কোনোটাই হয়ে ওঠেনি। যে পত্রিকা তাঁর একটা লেখাও ছাপেনি কোনোদিন, সেই পত্রিকা এখন তাঁর জীবন নিয়ে ফিচার করবে। আর সেটার দায়িত্ব পড়েছে আমার ওপর।

সময় দেওয়া হয়েছে তিন দিন। খবর গরম থাকতে থাকতে পরিবেশন না করলে কাটবে না। এ অল্প সময়ে বাবু মণ্ডলের কোনো বই আমার পক্ষে পড়ে ফেলা সম্ভব নয়, কাজেই প্রকাশিত যে কয়েকটি বই আছে সেগুলোর নাম মুখস্থ করে রওনা হলাম নিচিনপুরের দিকে। নিচিনপুরেই কেটেছে বাবু মণ্ডলের জীবনের বাল্য ও যৌবন। বাকিটা সময় তিনি সপুরাহাট গঞ্জে কাটিয়েছিলেন। আমার সঙ্গে গেলেন হাসু ভাই। হাসু ভাই আগে একটি বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে কাজ করতেন, সুবিধা না করতে পেরে আমাদের পত্রিকা অফিসে জয়েন করেছেন। তাকে সঙ্গে নেয়ার কারণ তিনি বাবু মণ্ডলের অঞ্চলেরই মানুষ, একবার বাবু মণ্ডলের একটা কবিতাও নাকি পড়েছিলেন। কবিতার প্রথম লাইনের একটা শব্দ তার এখনও মনে আছে, শব্দটি হল ‘পিরিত’। গাড়িতে গর্বের সঙ্গে বেশ কয়েকবার জানালেন সে কথা। এ নিয়ে তিনি ছোটখাটো একটা গবেষণাও করে ফেললেন। তার ধারণা, কবিতাটি যদি কবি প্রথম জীবনে লিখে থাকেন তাহলে তিনি কোনো তরুণীকে মাথায় রেখে লিখেছেন। এবং মেয়েটি সম্ভবত খুব একটা শিক্ষিত ছিল না, এজন্যই ‘প্রেম’ শব্দটা ব্যবহার না করে তিনি ‘পিরিত’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। আর যদি জীবনের শেষের দিককার লেখা হয় তাহলে এ ‘পিরিত’ বলতে তিনি জগতের প্রতি মায়াকে বুঝিয়েছেন। কারণ বৃদ্ধবয়সে পুরুষেরা নারী ছেড়ে প্রকৃতি ও ধরনীর প্রেমে পড়ে। বিকল্পসুখের সন্ধান করে। ফ্রয়েডীয় তত্ত্বমতে, এটাও এক ধরনের যৌনতা। ইম্প্রেসিভ! ভেরি ইম্প্রেসিভ! আপাতত তাও কবি সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া গেল।

আমরা বিকাল ৪টায় নিচিনপুরে পৌঁছলাম। গ্রাম বলতে যা ধারণা করে এসেছিলাম, নিচিনপুর ঠিক তার উল্টো। মিনি শহর বললে ভুল বলা হবে না। গ্রামে ঢুকেই বেশ বড়সড় একটা মোড়। এখানে খাওয়ার হোটেল, ডিসপেনসারি থেকে শুরু করে নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকানপাট আছে। অনেক মানুষের জটলা সেখানে। হাসু ভাই বললেন কাজটা এখান থেকেই সেরে ফেলতে। আমাকে যেটা করতে হবে তা হল, বাবু মণ্ডলের কাছের কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলে তার জীবনবৃত্তান্ত লিখে নিয়ে যেতে হবে।

হাসু ভাইয়ের কাছে একটা রেকর্ডার ছিল। হোটেলে চা-সিঙ্গাড়া খেতে খেতে উঠল কবি বাবু মণ্ডলের কথা। হোটেলের মালিক হেতেম মিয়া কবি সম্পর্কে অনেক কথাই বললেন। যথাসম্ভব এডিট না করে তার মুখের কথায় আমি এখানে উঠিয়ে দিচ্ছি:
‘হেই খুব ভাল লোক ছেল। মানষের মুখে তার কথা অনেক শুনচি। ওরা নাকি সেই গরিব ছেল! আমাদের তো কবকার দুকান, তেকুন দুকানে আমার দাদার সাথে বাপও বসতুক। বাপের থেকি বয়সে বাবু মণ্ডল বছর পাঁচেকের ছোট ছেল। বাপরা সবাই তাকে হাবু বুলি ডাকতুক। বুদ্ধি-শুদ্ধি নাকি কিছুই ছেল না। আমাদের হটিলের ছুতুতে খালি বসি থাকতুক। আমার বাপের ছোট-খাটোও হুকুম-টুকুমও শুনতুক। একবার নাকি তার আমাদের হটিল কাজ করার খুব খায়েস হয়লো। আসলে এই এলাকায় আমাদের হটিল ব্যবসার খুব নাম-ডাক আছে। শুনচি শেষ বয়সে লোকটা না খেতি পেয়ি মরি গিছে। কি সব কবিতা-টবিতা নাকি লিকতুক। মানষের ভিমরুতি ধরছি যা হয়! সারাজীবন ধরি কি সব লিখলু, একটাও কাজে দিলু না। বিনা চিকিৎসায় মরলু। হের বইয়ির কাগজ দি আমার হটিলের মানষে একুন হাত মোচে।…’

সে বকেই চলে একটানা। হাসু ভাই বিরক্ত হয়ে রেকর্ডারটা অফ করে ফেলেছিল।

ওইদিন ওখানেই সন্ধ্যা হয়ে এলো। আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হল গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার মান্নান সাহেবের বাড়িতে। হাসু ভাই আগেই ব্যবস্থা করেছিল সব। রাতে মান্নান সাহেবের বাড়িতে বেশ ভালোই খাওয়া-দাওয়া হল। মান্নান সাহেব আমার বাবার বয়সী, আর আমার বাবার বয়স কত আর, এই ৫৫ বছর হবে, মানে জীবিত থাকলে সেটাই হতো আর কি! খাওয়া-দাওয়া শেষ করে কবি বাবু মণ্ডলের প্রসঙ্গে আমরা কথা বলা শুরু করলাম। হাসু ভাই ঘুমাতে গেল। শরীরটার মতো ঘুমও তার বেজায় ভারী। এ দুটোকে সামলাতে তাকে বেশ হিমশিম খেতে হয়। এ নিয়ে আমাদের অফিসে মজাও কম হয় না। অফিসে কাজের সময়ে কেউ হাসু ভাইকে কিছু জিজ্ঞেস করলে শুরুই করেন এই বলে—হাসু কি জেগে আছ? সে অন্য প্রসঙ্গ। আমরা প্রখ্যাত কবি বাবু মণ্ডল সম্পর্কে কথা বলছিলাম। মান্নান সাহেব পান মুখে গুঁজে বলা শুরু করলেন। ভঙ্গিমাটা এমন যেন তিনি টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। রেকর্ডারটা হাতে শক্ত করে ধরেছিলেন। ‘বাবু মণ্ডল বড় ঘরের ছেলে ছিল। মণ্ডল বাড়ির একমাত্র ছেলে ছিল বাবু মণ্ডলের দাদা হাফেজ মণ্ডল। কিন্তু লোকটা সংসারী ছিলেন না মোটেও, শুনেছি তিনি নাকি আমার দাদার পেছনে ঘুরঘুর করতেন। আমার দাদা এডুকেট মানুষ ছিলেন। দশগাঁয়ে তার মতো এডুকেট মানুষ দুটো ছিল না। ইংরেজরাও নাকি দাদার ইংরেজি শুনে টাসকি খেয়ে যেত! দাদার কাছ থেকে বাবাও ভালো ইংরেজি শিখেছে। আর আমি বাবার কাছ থেকে শিখেছি খানিকটা। (আমি বাবু মণ্ডলের প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দিলে)। ও হ্যাঁ, বাবু মণ্ডলের দাদা জুয়া খেলে, এ-দেশ সে-দেশ জার্নি করে সব সম্পত্তি শেষ করে ফেলল। একেবারে যে কিছু ছিল না তাদের তা না। বাবু মণ্ডল যদি শক্ত করে ফ্যামিলির হালটা ধরত তাহলে ভালোই চলত তার। বাবু মণ্ডল আমার থেকে বছর তিনেকের সিনিয়র ছিল। স্কুলে দেখতাম, পড়াশোনা না করে গাছপালা-মেয়েমানুষ মিশিয়ে কি সব লিখছে! আমি ক্লাস টু-এর ছাত্র হয়ে যা জানতাম ও ক্লাস ফাইভের ছাত্র হয়েও তা জানত না। পরে আমি যখন ক্লাস ফাইভে উঠলাম, ততদিনে সে লেখাপড়াই ছেড়ে দিল। ভাতের জন্য কিছু না করলে কি আর ফ্যামিলি টেকে? টেকেওনি। (তার কোনো কবিতা পড়েছেন কিনা জানতে চাইলে, একটু বিরক্ত হয়ে।) আমার বাপু অত টাইম কোথায়? স্কুলের হেডমাস্টারি করা চারটেখানিক কথা? কত ঝামেলা-ঝক্কি পোহাতে হয়। তোমরা ছেলে-ছোকরা পোলাপান, তোমরা ওইসব পড়বা। আর তাছাড়া আমি ইংরেজির ছাত্র। তবে শুনেছি ভালো লিখত। একবার আমাদের স্কুলে যিনি বাংলা পড়ান, বলতে শুনেছিলাম, রবীন্দ্রনাথের মতো লাইন-ঘাট থাকলে নাকি নোবেল জিতা বাবু মণ্ডলের ওয়ান-টুর ব্যাপার! সে যে লেখাপড়া না জেনে শুদ্ধ করে লিখতে পারত এই তো বিরাট ব্যাপার।’

মান্নান সাহেব আরও অনেক কথা বলেছিলেন। কিন্তু কখন যে রেকর্ডারের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল টের পাইনি। তাই তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথাই প্রকাশ করা সম্ভব হল না।

রাতে ঘুমটা বেশ ভালো মতোই হল। পরদিন সকালে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। শেষবারের মতো আমরা আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম। তাদের মধ্যে হুজুর গোছের এক ব্যক্তি কবি বাবু মণ্ডলের বিরুদ্ধে অ-ইসলামিক কথাবার্তা বলার অভিযোগ তুললেন। তিনি বললেন:
‘লোকটা সারাজীবন কি সব অকাম-কুকাম লিখচে। শেষ বয়সেও ভীমরতি ধরছিল। গঞ্জে কাকে নাকি মেয়ি পাতি তার বাড়িতে থাকতুক। নাউজুবিল্লাহ! লোকটাকে আমি একদিনও মজ্জিদে দেখি নি। আল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি সময় মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে না কাল কেয়ামতে তার জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন শাস্তি। এই সব পাঁজি লোকদের সমাজ থেকে উচ্ছেদ করা উচিত।’

শিক্ষিত আধা বয়স্ক সোবহান বললেন-
‘খুবই চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন। তার চিন্তা মোতাবেক আমরা যদি সমাজটাকে সাজাতে পারতাম তাহলে কি আর এত অশান্তি হয়? তিনি মানুষ নিয়ে ভাবতেন, সমাজ নিয়ে ভাবতেন। তার লেখা পড়ার সুযোগ আমার হয়নি। কিন্তু তার সাথে একবার কথা বলার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।’

এক কলেজপড়ুয়া মেয়েকে কবি বাবু মণ্ডল সম্পর্কে জানতে চাইলে বললেন, ‘বাবু মণ্ডল? কে সে? আপনে কি আমাদের কলেজের পিয়ন বাবু ভাইয়ের কথা বলছেন?’

আমাদের ঢাকা ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। আসার পথে বাবু মণ্ডলের কবরটা রাস্তার বাঁ-হাতে পড়েছিল। হাসু ভাই ঘুমাচ্ছিল বলে আর নামা হয়নি। তাছাড়া ঢাকায় ফিরেই কাজটা রেডি করতে হবে, এত সময় কই?

গল্প
যেভাবে লেখা হলো বাবু মণ্ডলের জীবনবৃত্তান্ত / ২০০৯

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments