Homeমুক্তমতবইমেলা তথ্যপ্রযুক্তি ও মিডিয়ার ভূমিকা - স্বকৃত নোমান

বইমেলা তথ্যপ্রযুক্তি ও মিডিয়ার ভূমিকা – স্বকৃত নোমান

বইমেলা তথ্যপ্রযুক্তি ও মিডিয়ার ভূমিকা
স্বকৃত নোমান

একুশে বইমেলা যে এখন একটি জাতীয় উৎসবের রূপ নিয়েছে, এর পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে গণমাধ্যম। আমাদের টিভি, পত্রিকা আর অনলাইন পোর্টালগুলোর অব্যাহত প্রচারের ফলে বইমেলার খবর পৌঁছে যায় সর্বমহলে। প্রকাশকদের বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই। অধিকাংশ প্রকাশকের দায়বোধ বলতে কিছু নেই। বইয়ের প্রতি তাদের কোনো যত্ন থাকে না। খুব কম প্রকাশক বইয়ের যত্ন নেন। অধিকাংশের মানসিকতা হচ্ছে―‘ধর মুরগি জবাই কর।’

এবং শুনতে একটু খারাপ লাগলেও একথা সত্য, অধিকাংশ প্রকাশক বই কী জিনিস সেটাই বোঝে না। কারো মুখে শুনেছে অমুক লেখক ভালো, ব্যস ভালো। সেই ভালো লেখকটির পাণ্ডুলিপিটি পড়ে দেখার প্রয়োজন মনে করে না। অর্থাৎ ধর মুরগি জবাই কর। এরা সংখ্যায় বেশি। এদের কাছে প্রকৃত প্রকাশকরা কখনো কখনো অসহায় হয়ে পড়ে।

বইমেলাকে আমাদের গণমাধ্যমগুলো যেভাবে প্রচার দেয়, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। পণ্যায়নের এই যুগে প্রচারের কোনো বিকল্প নেই। পানির দেশ বাংলাদেশে বোতলজাত পানিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে প্রচার। প্রচার জনপ্রিয় করে তুলেছে অনেক ক্যানভাসারকেও। প্রচার বদলে দিচ্ছে মানুষের রুচি, খাদ্যাভাস, সংস্কৃতি।

পণ্যায়নের এই কালে বইও একটি পণ্য। লেখকের কাছে সেটা মহৎ সাহিত্যকর্ম হতে পারে, প্রকাশকের কাছে সেটি পণ্য বৈ আর কিছু নয়। সেই পণ্যের খবর যদি প্রকাশক ভোক্তা সাধারণকে জানাতে না পারেন, তা যত মহৎ সাহিত্যকর্মই হোক না কেন, কেউ কিনবে না। কেননা যুগটা তথ্যের। ইনফরমেশন টেকনোলজির। মানুষ তথ্য চায়। তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই সে সবকিছু নির্ধারণ করে।

গত পনেরো বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বইমেলায় বিস্তর মানুষ বই কিনতে আসে বাসা থেকে বইয়ের তালিকা করে। সেই তালিকা তারা কোথা থেকে তৈরি করে? করে পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপন থেকে, টিভিতে প্রচারিত খবর থেকে, ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট থেকে। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা ভালো বইগুলোই তালিকায় রাখে।

কেউ বলতে পারেন, আশি বা নব্বইয়ের দশকে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক, বা রফিক আজাদ প্রমুখের কালে তো এত গণমাধ্যম ছিল না, এত প্রচার ছিল না। তখন কি মানুষ বই কিনত না? জি, তখনও মানুষ বই কিনত। কিন্তু তখন লেখকের সংখ্যা ছিল কম। তখন মানুষ ছিল দশ-বারো কোটি, এখন প্রায় আঠারো কোটি। এখন লেখকের সংখ্যাও বেড়েছে। প্রতি বছর চার-পাঁচ হাজার বই প্রকাশিত হচ্ছে। শৌখিন লেখকের সংখ্যাও বেড়েছে। বিত্তবানরাও এখন টাকা-পয়সা খরচ করে একটি বই প্রকাশ করে ফেলছে। এত এত লেখকের ভিড়ে সত্যিকারের বইটি, যে বইটি পাঠকের মনন গঠন করে, খুঁজে পাওয়া সাধারণ পাঠকের পক্ষে একটু কষ্টকর।

বইমেলা এলে প্রচার-প্রচারণার কত ধরণ যে দেখতে পাই! ভালো। এসব খুব ভালো লাগে। বই নিয়ে যে কোনো তৎপরতাকে ইতিবাচকভাবে দেখি। বই নিয়েই তো, ইয়াবা নিয়ে তো নয়, ফেনসিডিল নিয়ে তো নয়, চাপাতি বা বোমা নিয়ে তো নয়।

কেউ যদি মনে করেন, না ভাই, আমি এসব প্রচার-প্রচারণার মধ্যে নেই। সত্যিকারের সাহিত্যের প্রচার লাগে না। একদিন পাঠক নিশ্চয়ই সেই সত্যিকারের বইটি গ্রহণ করবেই। ঠিক, আপনার সঙ্গে বিন্দুমাত্র দ্বিমত করি না। বন্যার ঘোলা জল সমুদ্রে চলে যায়। মহাকালের গ্রাসে চলে যায়। কিন্তু থেকে যায় পলি। সেই পলি উর্বর। সেই পলি উৎপাদন করে শস্য। প্রকৃত সাহিত্য হচ্ছে সেই পলি। তবে ভাই, একটু কথা আছে। ঘোলা জল সমুদ্রে চলে যাওয়া পর্যন্ত আপনাকে প্রতীক্ষা করতে হবে। সেই প্রতীক্ষা আমৃত্যুও হতে পারে।

মহাকালে রেখাপাত
২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments