Homeমুক্তমতসহজপাঠ : শিশুশিক্ষার এক বিস্ময়কর বিনির্মাণ - রাজু বিশ্বাস

সহজপাঠ : শিশুশিক্ষার এক বিস্ময়কর বিনির্মাণ – রাজু বিশ্বাস

প্রবন্ধ

সহজপাঠ : শিশুশিক্ষার এক বিস্ময়কর বিনির্মাণ
রাজু বিশ্বাস

কালের গ্রাসে হারিয়ে যায় সভ্যতা সংস্কৃতি সাম্রাজ্য। কিন্তু শিক্ষা হারায় না; এক প্রজন্ম থেকে সে প্রবাহিত হয়ে চলে অন্য প্রজন্মের দিকে। ভারতবর্ষের একজন অসামান্য সাহিত্যকার হিসেবে কেবল নন, একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদ হিসেবেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উল্লেখযোগ্য। শিশুদের জন্য আজীবন তিনি ভেবেছেন; তার রচিত শিশুসাহিত্যের সংখ্যাও কম নয়। তবে জীবনের প্রায় অন্তিম পর্বে এসে তিনি রচনা করলেন বাংলা বর্ণ তথা ভাষা শিক্ষার এক অবিস্মরণীয় প্রাইমার গ্রন্থ ‘সহজপাঠ’ (প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ)। গ্রন্থ দুটি প্রকাশিত হয় ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে। তার প্রায় ৭৫ বছর পূর্বে বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন শিশুশিক্ষার অন্যতম অপরিহার্য গ্রন্থ ‘বর্ণপরিচয়’। এর পাশাপাশি ‘হাসিখুশি’, ‘চারুপাঠ’ ‘বর্ণমালা’ প্রভৃতি বহু প্রাইমার লিখিত হলেও কালের সীমাকে অতিক্রম করে আধুনিক কালের কাছেও সমধিক আবেদন নিয়ে আপন স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে এই দুটি গ্রন্থ।

‘সহজপাঠ’ প্রথম ভাগ স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ শিক্ষার একটি সরস সহজ ও ছন্দোবদ্ধ পাঠ্য গ্রন্থ। শিশু মনস্তত্ত্বের উপযোগী ভাষা ছন্দ চিত্রকল্পের ব্যবহারে রবীন্দ্রনাথ ‘সহজপাঠ’ এর প্রথমভাগে অনন্য সৃজনদক্ষতার এক অপূর্ব স্বাক্ষর তুলে ধরেছেন। এখানে প্রকৃতি ও পরিবেশের পরিচয় নিবিড়ভাবে তুলে ধরা হয়েছে খুব ছোটছোট ছড়ার মাধ্যমে। ছড়াগুলির ভাষা এতোটাই সরল ও মজার যে শিশুদের সঙ্গে সঙ্গে বড়দের মনও এগুলি পাঠ করতে করতে কখন যেন শিশু হয়ে ওঠে। স্বরের প্রথম দুটি বর্ণ দিয়ে সহজপাঠের শুরু :

“ছোট খোকা বলে অ আ
শেখেনি সে কথা কওয়া”

এই ছোট্ট দুটি লাইনের মধ্যে দিয়ে শিশু মনে চিরস্থায়ীভাবে যেন আঁকা হয়ে যায় ‘অ’ এবং ‘আ’ বর্ণের চিত্র। এভাবে –

”হ্রস্ব ই দীর্ঘ ঈ
বসে খায় ক্ষীর খই
হ্রস্ব উ দীর্ঘ উ
ডাক ছাড়ে ঘেউ ঘেউ’…

ইত্যাদি ছড়াগুলির মধ্যে প্রতিটি বর্ণ হয়ে উঠেছে এক একটা জীবন্ত প্রাণী; ফলত বর্ণগুলির সঙ্গে শিশুদের আত্মিক যোগাযোগ গড়ে উঠেছে সহজে। তারা একই সঙ্গে শিখতে পারে বর্ণের সঠিক উচ্চারণ ও ব্যবহার। এ গ্রন্থ পাঠের ফলে ভাষা থেকে ভাষা শিল্পের অর্থাৎ সাহিত্যের বোধ জন্মায় শিশুর। খুব সহজ ও সাবলীল ভাষায় রবীন্দ্রনাথ উপস্থাপন করেছেন বিশেষত গ্রামীণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনচিত্র। সহজপাঠ গ্রন্থের দ্বিতীয়ভাগে প্রকৃতি ও পরিবেশ পরিচিতির সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ছোট ছোট শিশুপাঠ্য গল্প ও ছড়ার মধ্য দিয়ে শিশুদের মনোরাজ্যে সোনার যাদুকাঠি ছুঁইয়ে দিয়েছেন। যা শিশুদের কল্পনা শক্তিতে করে আরও বিস্তৃত ও মসৃণ। একই সঙ্গে শিশু নানা ধরণের সামাজিক নীতিশিক্ষা লাভ করে। নন্দলাল বসুর আঁকা সহজপাঠের অসাধারণ ছবিগুলি রবীন্দ্রনাথের লেখাগুলিকে দিয়েছে অনন্য মাত্রা। প্রতিটি ছবি যেন কথা বলে উঠেছে। সাকুল্যে তেরোটি পাঠ (ত্রয়োদশ) সম্বলিত সহজপাঠ এর দ্বিতীয় ভাগের গল্পের সঙ্গে আছে করে অসামান্য সব ছড়া। ছড়াগুলি আজো শিশুসহ অনেক প্রাপ্ত বয়স্কদের মুখে মুখে ফেরে। বিশেষত ‘কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি’, ‘এসেছে শরত হিমের পরশ’ ‘অঞ্জনা নদীতীরে চন্দনা গাঁয়ে”… ইত্যাদি ছড়াগুলি শিশুমনে চিরায়ত আসন করে নিয়েছে। সহজপাঠ সামগ্রিক অর্থেই শিশুশিক্ষার এক বিস্ময়কর বিনির্মাণ।


সহজপাঠ কেবল শিশুর বর্ণ বা বাংলা ভাষা শিক্ষার বই নয়, এখানে তৎকালীন গ্রামীণ জনজীবনের দৈনন্দিন জীবনচর্যার চিত্র সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। রবীন্দ্রনাথ কলকাতার বাসিন্দা হলেও জীবনের একটা বড় পর্ব কেটেছে বাংলাদেশের পদ্মার তীরবর্তী গ্রামগুলিতে; তাছাড়া পরবর্তীকালে বোলপুর শান্তিনিকেতন ছিল রবীন্দ্রনাথের চারণ ও সাধনভূমি। শহরের তুলনায় গ্রামীণ প্রাকৃতিক ও জনজীবনের চিত্র তাঁর লেখায় সাবলীলভাবে উঠে এসেছে; ‘গল্পগুচ্ছ’-এর একাধিক গল্প ও অসংখ্য ছড়া-কবিতায় আমরা তার পরিচয় পাই। ‘সহজপাঠ’ প্রথম ও দ্বিতীয়ভাগে অত্যন্ত সহজ ভাষায় শিশুমনের উপযোগী বাক্য প্রয়োগে রবীন্দ্রনাথ তুলে এনেছেন দৈনন্দিন জীবনের নানা ছবি। প্রথমভাগে স্বর বর্ণ ও ব্যঞ্জন বর্ণ পরিচয়ের ছলে কবি এঁকেছেন গ্রামীণ জীবনের নানা খণ্ডচিত্র। শৈশবের দিনগুলি সহজপাঠের মধ্য দিয়ে আমাদের মনে বর্ণময় হয়ে ওঠে :

ক খ গ ঘ গান গেয়ে
জেলে ডিঙি চলে বেয়ে।
* * *
প ফ ব ভ যায় মাঠে
সারাদিন ধান কাটে।

মাঝিরা যে সে সময় নদীতে ডিঙি নৌকা বাইতে বাইতে মনের আনন্দে গান গাইত, নদীর চরে বসে রান্না করতো হয়তো কোনও মাঝিবৌ; কবি তার নাম দিয়েছেন “ঙ”, হাওয়ায় তার চোখে ধোঁয়া লাগে। কাঁধে ঢাকঢোল নিয়ে মানুষের কোলাহল, দল বেঁধে ছেলেদের আম পাড়তে যাওয়া, চাষিদের ধান কাটা, গরুর গাড়িতে পাকা ধান নিয়ে চাষিদের বাড়ি ফেরা ইত্যাদি গ্রামীণ জীবনের চিরপরিচিত ছবি সহজপাঠ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ অনন্য দক্ষতায় প্রকাশ করেছেন।

সহজপাঠের দ্বিতীয়ভাগে আরও একটু বিস্তৃতভাবে গ্রাম-গঞ্জের দৈনন্দিন জীবনচিত্র উঠে এসেছে। দ্বিতীয় ভাগের প্রথম পাঠে রবীন্দ্রনাথ এক বাদল দিনের ছবি এঁকেছেন। বংশুর ছাতা মাথায় সংসারবাবুর বাড়ি যাওয়ার দৃশ্য, সেখানে ‘কংসবধের অভিনয়’ দেখা ইত্যাদি গ্রামীণ জনজীবনের চালচিত্র সহ্জপাঠে প্রচুর আছে। ‘আদ্যনাথ বাবুর কন্যার বিয়ে’র আয়োজন, বিয়ে বাড়ি আনন্দে ছেলেদের নাচ, ‘ব্যাটবল খেলা’ ইত্যাদি বিষয়গুলি সেকালের গ্রামীণ জীবনের সহজ ও সাবলীল রূপকে প্রকাশ্যে এনেছে। সহজপাঠের বিখ্যাত ‘হাট’ কবিতায় একটি গ্রাম্য হাটের পরিপূর্ণ চিত্র উঠে এসেছে :

কুমোর-পাড়ার গরুর গাড়ি-
বোঝাই-করা কলসি-হাঁড়ি
গাড়ি চালায় বংশী বদন,
সঙ্গে যে যায় ভাগ্নে মদন…

বস্তুত এই ছড়াটি পাঠের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ‘বক্সীগঞ্জে পদ্মাপারে’র শুক্রবারের সেই হাটের ছবি আজো আমাদের হৃদয়ে অমলীন হয়ে আছে। এ ছাড়াও সহজপাঠে উঠে আসা আরও বহু দৈনন্দিন জীবন চিত্রের কথা বলা যায়- মঙ্গলবারে পরিবেশ পরিস্কার রাখতে ছেলেদের জঙ্গল সাফ করতে যাওয়া, চাষের খেতে পঙ্গপালের উৎপাত, বৈষ্ণবীর গান শোনানো, মাঝরাতে ‘উল্লাসপাড়ার মাঠে’ শেয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক, ভক্তরামের নৌকায় শক্তিনাথ বাবুর নদীতে বেড়াতে গিয়ে বাঘের কবলে পড়া, পালকি চড়া, দরিদ্র মজুর উদ্ভব মণ্ডলের কন্যা নিস্তারিণীর বিয়েতে পদ্মপুকুর থেকে রুই মাছ ধরে অবস্থাপন্ন দুর্লভ বাবুর কাছে শাস্তিভোগ… ইত্যাদি চিত্রের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ একদিকে যেমন গ্রামজীবনের দৈনন্দিন রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন, অপর দিকে শিশুমনে সমাজের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা দিতে চেয়েছেন। তাদের মধ্যে ন্যায়-অন্যায়বোধকে জাগাতে চেয়েছেন। আজকের দিনেও শিশুশিক্ষার প্রাথমিক স্তরে ‘সহজপাঠ’ এর প্রাসঙ্গিকতা একটুও কমেনি।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments