Homeমুক্তমতবাফার মাসান্তের বৈঠকে কবি শহীদ কাদরী - বেনজির শিকদার

বাফার মাসান্তের বৈঠকে কবি শহীদ কাদরী – বেনজির শিকদার

[]বাফার মাসান্তের বৈঠকে কবি শহীদ কাদরী[] বেনজির শিকদার

বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টস— বাফার আয়োজনে গত রবিবার ০৮-২৯-২০২১, নিজস্ব কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বাফার নিয়মিত আয়োজন মাসান্তের বৈঠক ‘শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি’। এবারে পর্বটি সাজানো হয়েছিল বাংলা কবিতার বরপুত্র কবি শহীদ কাদরীকে ঘিরে।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বাফার প্রধান ফরিদা ইয়াসমিন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া আদর্শ বুকে ধারণ করে বাংলা শিল্প ও সাহিত্য চর্চার মধ্যদিয়ে আমরা তা বাঁচিয়ে রাখবো এবং আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেবো।

সঞ্চালক ক্লারা রোজারিও, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, কবি মহাদেব সাহার লেখা কবিতা পাঠের মাধ্যমে তার সঞ্চালনা শুরু করেন। বিশেষভাবে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি শামসুর রাহমান, কবি হুমায়ুন আজাদসহ বাংলা সাহিত্য সম্মৃদ্ধকরণে যেসকল কবিসাহিত্যিক আগস্ট মাসে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদেরও।

এসময় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাফার গিটার শিক্ষক এ এফ এম আফতাবুজ্জামান স্পন্দন পরিবেশন করেন “শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি… বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ” গানটি।

এরপর শুরু হয় বাফার নিয়মিত আয়োজন মাসান্তের বৈঠক।এই পর্বটি নিবেদন করা হয়, কবি শহীদ কাদরীর স্মরণে।

স্মরণ পর্বের শুরুতে আবৃত্তিশিল্পী নজরুল কবির, কবি শহীদ কাদরীর লেখা ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে তিনি আবারও আবৃত্তি করেন, কবি’র ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতাটি। একইসাথে মোহাম্মদ নাসির উল্লাহ, উক্ত কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করে শোনান। উল্লেখ্য যে, কবিতাটি তার অনুবাদকৃত।

সাহিত্য একাডেমির পরিচালক, মোশাররফ হোসেন, বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি; কবি শহীদ কাদরী সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, কবি শহীদ কাদরী ছিলেন, ‘সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্ক’র একমাত্র উপদেষ্টা। কবি শহীদ কাদরী এই শহরে থাকার জন্যে আমরা যারা তার কাছাকাছি গিয়েছি; তারা প্রত্যেকেই নিজেদের বড়ো ভাগ্যবান মনে করি। এমন একজন প্রাজ্ঞ মানুষের সংস্পর্শে আমাদের মানসিকতায়, চিন্তায় এবং এই শহরে শিল্পসাহিত্য কার্যক্রমে অভিনব এক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। শহীদ কাদরীর প্রতি সম্মান জানানোর এ আয়োজনের জন্য তিনি বাফাকে সাধুবাদ জানান।

কবি শামস আল মমীন তার বক্তব্যে বলেন, আমার সাথে কবির পরিচয় ১৯৮৫ সালে। এরপর থেকে ধীরেধীরে তার সাথে ঘনিষ্ঠতা। তিনি আরও বলেন, তার কবিতার যে ভাষা এটা সত্যিই অদ্ভুত ব্যাপার! তিনি কবি শহীদ কাদরীর সাথে তার বেশকিছু স্মৃতিকথা তুলে ধরেন।

 

বাফাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বিশিষ্ট নাট্যশিল্পী শিরিন বকুল, শহীদ কাদরীর লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ’ ও ‘একটি উত্থান পতনের গল্প’ কবিতা দুটি আবৃত্তি করে শোনান।

কবির কাব্য ও কবিতা বিষয়ক আলোচনায় লেখক গবেষক আহমাদ মাযহার বলেন, আব্দুল মান্নান সৈয়দ মাত্র তিনটি শব্দ দিয়ে কবি শহীদ কাদরীর বৈশিষ্ট্য চিনিয়েছিলেন। তা হচ্ছে; ১. প্রতিতুলনা ২. প্রতিষঙ্গ এবং ৩. প্রতিসাম্য। তার মতে, এই তিনটি শব্দের যে তাৎপর্য; তা অর্জন করতে গেলে একটা মানুষের মধ্যে বৈচিত্রময় পরস্পর বিরোধিতা থাকতে হবে। আর সেই বৈচিত্রময় পরস্পর বিরোধিতাকে একটি মালা গেঁথে একটি নাটকীয় পরিচর্যা করতে হলে যে প্রতিভা দরকার; তা শহীদ কাদরীর ছিল। তিনি বলেন, শহীদ কাদরীর কবিতার যে বাকভঙ্গি, যে ভাষা, তুলনা প্রতি-তুলনা; তা আমাদের পূর্ববাংলার অন্যান্য কবিদের থেকে আলাদা। অর্থাৎ তার অনুভূত-উপলব্ধ যে চেতনা; তার মূল ছিল দেশে। তিনি উল্লেখ করেন, পাঠকরা তাদের কাব্যতৃষ্ণা দিয়ে শহীদ কাদরীকে আবিষ্কার করেছেন।

কবি তমিজ উদ্দিন লোদী বলেন, শহীদ কাদরী সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন, এই গুণটি বিরল; যা সবার মধ্যে থাকে না। কবি শহীদ কাদরী যখন জন্মেছিলেন; তিনি বারুদের গন্ধ নিয়ে জন্মেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তরকাল এবং যুদ্ধের একটি আবহের মধ্যেই তিনি জন্মেছিলেন। আজীবন শুদ্ধ কবিতার অন্বেষণে তার কবিতায় উপমা, নির্মাণ পঞ্চাশের ষাটের এবং তার পূর্বসূরি চল্লিশের দশকের অনেক কবিদের চেয়ে তিনি আলাদা হয়েছেন তার শব্দ নির্মাণে, তার উপমায়, চিত্রকল্পে এবং বিষয় নির্মাণে।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লেখক সোনিয়া কাদির বলেন, ১৯১৩ সালে কবি শহীদ কাদরীর ৭১তম জন্মদিনে কবিকে সংবর্ধনা দেবার জন্য সাহিত্য একাডেমি এবং বাফাসহ অনেকগুলো সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে জন্মোৎসবের আয়োজন করেছিল। সেই সময়ে সাহিত্য একাডেমির সুবাদেই কবির সংস্পর্শে যাবার সৌভাগ্য হয়। তিনি বলেন, মানুষ শহীদ কাদরী ক্ষণজন্মা; তার কবিতায় তিনি টিকে থাকবেন অসংখ্য দিন পর্যন্ত। সবশেষে কবি শহীদ কাদরীকে শ্রদ্ধা জানাতে, এই অনন্য আয়োজনের জন্য বাফার প্রতি বিশেষ ধন্যবাদ জানাবার পাশাপাশি সবাইকে আহ্বান জানান এভাবেই বাফার পাশে থাকতে।

কমিউনিটি একটিভিস্ট সিরাজ উদ্দিন আহমেদ সোহাগ বলেন, ২০১০ সালে বাংলাদেশ সোসাইটির উদ্যোগে ১১৭টি সংগঠন মিলে সম্মিলিত একুশ উদযাপনের সময়; এবং ২০১৪ সালে সার্বজনীনভাবে কবিকে সম্মাননা দিতে পারাটা আমাদের জন্য অত্যন্ত সৌভাগ্যের ছিল।

অনুষ্ঠানে আগত খুব কাছ থেকে দেখা শহীদ কাদরীর অন্যতম তরুণ বন্ধু নাট্যব্যক্তিত্ব এজাজ আলম বলেন, শহীদ কাদরী সম্পর্কে স্মৃতিচারণ বলতে আমি মনে করি যে, শহীদ কাদরীর কবিতা পাঠ করাই সবচেয়ে ভালো, তাঁকে স্মরণ করার জন্য। তিনি শহীদ কাদরীর ‘সব নদী ঘরে ফেরে’ কবিতাটি পড়ে শোনান।

অনুষ্ঠানে লেখক এবং অভিনেত্রী লুতফুন নাহার লতা, কবি শহীদ কাদরীকে নিয়ে লেখা তার স্মৃতিকথা পাঠ করে শোনান।

কবি শহীদ কাদরীকে নিয়ে লেখা স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন, কবি কাজী আতিক, কবি আহমেদ ছহুল, কবি পলি শাহীনা এবং বেনজির শিকদার। কবি ছন্দা বিনতে সুলতান পাঠ করেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কবিতা।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, শরীফ হোসেন, খায়রুল ইসলাম পাখি, মিশুক সেলিম, ইয়াকুব আলী মিঠু, নাসির শিকদার, মাসুম আহমেদ, শম্পা রহমান, কানিজ ফাতিমা, প্রতিমা সুমি, সিসিলিয়া মরাল, শেলি সেমস, নুসরাত এলিন, শামীম আরা বেগম, ফারজানা ইয়াসমিন, মার্জিয়া স্মৃতি, সানজিদা ইসলাম, নুজহাত ফাইজা।

অনুষ্ঠানের সর্বশেষ পরিবেশনায় আবৃত্তিশিল্পী জে এইচ আরজু, বাফাকে বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আগস্ট মাসটি বাঙালি জাতির জন্য ভীষণ দুর্ভাগ্যের। দুর্ভাগ্যের শুরুটা হয়েছে, একজন অপ্রাপ্তবয়স্ককে নিয়ে, যাকে নিয়ে গান আছে— ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ ক্ষুদিরাম বসুর আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে। এরপর ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ চলে গেলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নিরুদ্দেশ হলেন ‘আমাকে রক্ত দাও আমি স্বাধীনতা দেবো।’ রবীন্দ্রনাথের ঠিক পরেই সুবাস চন্দ্র বোস। ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর, তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ চলে গেলেন আমাদের জাতীয় কবি। ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ চলে গেলেন বাংলাদেশের প্রধান কবিও। এরইমাঝে আমরা হারালাম আমাদের জাতির জনককে। তিনি বলেন, যারা বঙ্গবন্ধুর সৎকারে অংশগ্রহণ করেছিলেন, আমি তাদের একজন। এ যেমন আমার জন্য অনেক বড়ো প্রাপ্তি; তেমনি এই অগাস্টে চলে যাওয়া শহীদ কাদরী আরেকটি অধ্যায়, যার সান্নিধ্য আমি বিশটি বছর ধরে পেয়েছি। তিনি শহীদ কাদরীর লেখা ‘আপনারা জানেন’ কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান।

সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও আগামী মাসে বাফার মাসান্তের বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়ে, আয়োজনের পরিসমাপ্তি টানেন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ক্লারা রোজারিও।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments