নাটোরের “শিলা মিষ্টি বাড়ি “অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মিষ্টি তৈরির অভিযোগ, প্রশাসন নিরব
মাহাবুব খন্দকার, নাটোর নিউজ:
নাটোর শহরের প্রাণকেন্দ্রে নিমতলায় অবস্থিত শিলা মিষ্টি বাড়ি। আলো ঝলমলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাচের শোকেসে স্তরে স্তরে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি । নাটোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ক্রেতারা সর্বোচ্চ দাম দিয়ে মিষ্টি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন অহরহ। শিলা মিষ্টি বাড়ির দ্বিতীয় শোরুম রয়েছে নাটোরের বড় হরিশপুর বাইপাস মোড়ে এবং তৃতীয় শোরুম রয়েছে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া পৌরসভার সামনে।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র বলছে, প্রতিদিন এই তিনটি দোকান থেকে প্রায় ৫ মনের অধিক মিষ্টি সরবরাহ করা হয়। আর এই সমস্ত মিষ্টি তৈরি হয় যে কারখানাতে সেই কারখানায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মিষ্টি তৈরি হয় বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। শুধু এই একটি মিষ্টির দোকানই নয়, শহরের অন্যান্য মিষ্টির দোকান গুলোর অবস্থা প্রায় একই। দোকান চকচক করলেও এর কারখানায় দেখা মিলবে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, দুর্গন্ধ ময়লা আবর্জনার স্তুপ। এছাড়া যে সমস্ত পাত্রে করে দোকানে মিষ্টি পৌঁছে দেয়া হয় সেগুলোও নোংরা।
নাটোরের সচেতন মহল বলছেন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ও কেমিক্যাল ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন করা হলে পেটের অসুখ থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদী ধীর গতির বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত হবে মানুষ। প্রশাসনিকভাবে এই দোকানের কারখানায় অভিযান চালানো প্রয়োজন কিন্তু প্রশাসন কেন যে এই সমস্ত স্থানে অভিযান চালান না তা এক বিশাল রহস্য বলে মনে করছেন নাটোরের সচেতন মহল।
মিষ্টি ক্রেতা দেবব্রত সরকার জানান, চিনির দাম ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি। ছানা সর্বোচ্চ ২০০ থেকে আড়াইশো টাকা কেজি। অথচ ছানা দিয়ে তৈরি মিষ্টির দাম ৪০০ থেকে ৫০০ এমনকি ৬০০ টাকা কেজি পর্যন্ত। এছাড়া ভেজাল খাদ্য দ্রব্যের উপরে বিভিন্ন স্থানে অভিযান মাঝেমধ্যে পরিচালনা হলেও মিষ্টির দোকান গুলোতে কোন অভিযান চালানো হয় না এটা আমাদের কাছে রহস্যজনক মনে হয়। প্রশাসন ঠিক ভাবে তার দায়িত্ব পালন করছে না বলে আমাদের অভিযোগ।
সরেজমিনে দেখা যায়, নাটোর পৌরসভা ১ নং ওয়ার্ডের উত্তর চৌকিরপাড় মহল্লায় হরিজন কলোনির পাশে অবস্থিত শিলা মিষ্টি বাড়ির কারখানা। কয়েকজন শ্রমিক মিষ্টি তৈরির কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের হাতে নেই হ্যান্ড গ্লাভস এবং মাথায় ক্যাপ থাকার কথা থাকলেও তা নেই। উড়ছে মাছি বিভিন্ন জায়গায় মিষ্টি তৈরির সরঞ্জামাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অপরিষ্কার অবস্থায়। দুর্গন্ধ আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ।
কথা হয় কারখানার কারিগর আল আমিনের সঙ্গে তিনি জানান বর্তমানে এই কারখানাতে ৬ জন কর্মরত রয়েছে। করোনাকালীন সময়ের আগে কারিগর সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। মিষ্টি কি স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে তৈরি করা হচ্ছে? এমন প্রশ্নের কোন উত্তর জানা নেই তার তবে তিনি স্বীকার করলেন হাতে হ্যান্ডগ্লোভস এবং মাথায় ক্যাপ পরা দরকার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এলাকাবাসী জানালেন, এই কারখানার ধোঁয়ায় এলাকা দূষিত হচ্ছে। আবাসিক এলাকার মধ্যে উচ্চ সাউন্ড সিস্টেমে গান বাজানো হয়। নিষেধ করলেও কেউ শোনে না। কারখানার দুর্গন্ধযুক্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। অনেক সময় রাস্তা চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। এছাড়া সরকারি খাল ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে কারখানাটি।
নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার ভোক্তা অধিকার বিষয়ক সংগঠন ক্যাবের সভাপতি আব্দুল মজিদ বলেন, মিষ্টির কারখানা দুর্গন্ধ ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের যে অভিযোগ তা খুবই নিন্দনীয়। এ ব্যাপারে প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি দাবি করেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নেবেন। এবং যে সমস্ত কারখানাগুলো অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্ন উপায় খাদ্যদ্রব্য তৈরি করেছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
এ বিষয়ে শিলাবৃষ্টি বাড়ির প্রোপাইটার মোঃ মোখলেছুর রহমান মুকুলের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আপনারা সবাই সরোজমিনে আমার কারখানা পরিদর্শন করুন দেখুন সেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মিষ্টি তৈরি হয় কিনা। আমরা ভালো পরিবেশে মিষ্টি তৈরি করি কোন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আমাদের দোকানের মিষ্টি তৈরি হয় না বলে দাবি করেন তিনি।
নাটোর সদর হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, পরিপাকতন্ত্রে ভেজাল খাবারের জন্য হজমের গণ্ডগোল, ডায়েরিয়া এবং বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে যে উপসর্গগুলো দেখা যায় সেগুলো হলো- পেটব্যথাসহ বমি হওয়া, মাথাঘোরা, মল পাতলা বা হজম বিঘ্নিত মল, শরীরে ঘাম বেশি হওয়া এবং দুর্বল হয়ে যাওয়া, পালস্ রেট কমে বা বেড়ে যেতে পারে।
খাদ্যপণ্য ভেজালের কারণেই বিভিন্ন রকমের রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। বর্তমানে ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেলিউর, হৃদযন্ত্রের অসুখ, হাঁপানি এগুলো অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আর আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে রোগীদের লম্বা লাইন।
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে উৎপাদিত খাদ্য মানবদেহে প্রবেশ করলে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান ক্ষতিগুলো হয় আমাদের লিভার, কিডনি, হৃৎপি- ও অস্থিমজ্জার। ধীরে ধীরে এগুলো নষ্ট হয়ে যায়। বাচ্চা ও বৃদ্ধদের বেলায় নষ্ট হয় তাড়াতাড়ি, তরুণদের কিছুটা দেরিতে।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি নাটোর জেলা শাখার সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বকুল জানান, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন হয় এই কথা সত্য। সরকারি নির্দেশনা নিয়ম-নীতি অনেক দোকানদার মেনে চলে না। সমিতির পক্ষ থেকে সকল দোকানদাদের সতর্কতামূলক নির্দেশ দেওয়া হয়, তারা যেন পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্য তৈরি করেন এবং স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে সকল কারিগর থাকে।
নাটোর ইউনাইটেড প্রেস ক্লাবের সভাপতি রেজাউল করিম রেজা জানান, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মিষ্টি উৎপাদনের জন্য ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রশাসনের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের ‘বিষাক্ত খাদ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি’ শীর্ষক সেমিনারে বলা হয়, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত
হচ্ছে। ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা দেশে প্রায় ১৫ লাখ।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোঃ শামীম আহমেদ জানান, ভেজাল বিরোধী অভিযান সহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে,এছাড়া বাজার মনিটরিং সহ নানাবিধ অসঙ্গতিতে প্রশাসনিক মোবাইল আদালত সবসময়ই কাজ করছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য পেলে অবশ্যই সেই সমস্ত স্থানে অভিযান চালানো হবে।