Homeসাহিত্যকান্নার ঢেউ - রত্না চক্রবর্তী'র গল্প

কান্নার ঢেউ – রত্না চক্রবর্তী’র গল্প

বিভাগ – গল্প
কান্নার ঢেউ
রত্না চক্রবর্তী
২৮.১২. ২১

পাগলের মতো ছুটে এসেছিল বিশাখা সায়নতারাকে দেখার জন্য। ও যে মোবাইলে বলেছিল বড় করুণ করে ” প্লীজ ফোনটা নামিয়ে রেখে দিস নি, আমি তোকে সেদিনের সত্যিটা বলতে চাই। সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান করতে চাই। তোর অভিমানের এই বোঝা আর আমি বইতে পারছি না রে। আমি মরে যাব.. ” কিন্তু বিশাখা কথাটা এই অবধি শুনলেও আর শোনার ইচ্ছা হয় নি, বুকের মধ্যে রাগ দুঃখ কান্নার ঢেউ…

সেই নার্সারি থেকে… সেই তিনবছর বয়স
থেকে সায়নতারা আর সে বন্ধু। কলেজ অবধি পাশাপাশি বাড়ি ছিল, তারপর ওরা সল্টলেক চলে যায়। কিন্তু বন্ধুত্ব অটুট ছিল।
সায়নতারা জানত রূদ্রর কথা , কি প্রচন্ড ভালোবাসত বিশাখা রূদ্রকে… প্রতিটি গল্প এসে করত সায়নতারাকে… সায়নতারা শুনত কিন্তু ও একটু কম উচ্ছ্বাসপ্রবণ তাই তেমন হৈ হৈ করত না। ওর জীবন ছিল নাটক গল্প কবিতা নিয়ে। দারুণ লিখত, নাটকও খুব ভালো করত। খুব ইচ্ছা ছিল আর্টফিলম নিয়ে কিছু করবে। কিন্তু বুঝতে পারে নি বিশাখা যে জীবনেও ও নাটক চালিয়ে যাচ্ছিল।

রূদ্র ওদের কমন ফ্রেন্ড ছিল। রূদ্রর লেখটেখা আসত না ওর ঝোঁক ছিল শর্টফ্লিমের দিকে। ওর বাবা নিজেও ফ্লিম লাইনে ছিলেন। বিশাখার ছিল আঁকার জগৎ তাই তো রূদ্রের মতো সুপুরুষ সুদর্শন তাকে পাগল করে তুলেছিল। কত ছবি যে ও এঁকেছে রূদ্রকে নিয়ে… সব সব গোপন কথা নির্দ্বিধায় বলত সায়নতারাকে, ঘাসের দিকে তাকিয়ে মগ্ন হয়ে শুনত সেই গল্প সায়নতারা। তখন কি জানত বিশাখা কি ভাবছে ও… কি কল্পনা করছে ও…
জেনেছিল খুব ভয়ংকর ভাবে… আচমকাই গিয়েছিল সায়নতারার বাড়ি বিশাখা। আর্ট এক্সিবিশনে ওর ছবি বহু প্রশংসিত হয়েছে, মোট দশটা ছবি বিক্রি হয়েছে। তিনজন বলে গেছেন কিছু অন্য ছবি নেবেন, তারা রবিবার ওর বাড়ি আসবেন। খুশিটা নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পারছিল না বিশাখা, একবার ফোন করেছিল রূদ্রকে. ফোন অফ দেখে আর চেষ্টা করে নি। সত্যি বলতে কি যদি শুধু বন্ধুত্বের বিচার করে তো বিশাখা অনেক বেশি ভালোবাসে সায়নতারাকে, রূদ্রের চেয়েও…তবু ওর আর রুদ্রের মাঝে কিছু গোপনীয়তা আছে, কিন্তু সায়নতারা আর বিশাখার মাঝে সেই আড়ালটুকুও নেই।

ও বাড়িতে বিশাখার অবারিত দ্বার তাই কাকিমাকে বলেই উপরে চলে গিয়েছিল সায়নতারার ঘরে আর উঠতে উঠতেই কানে এসেছিল সেই ভয়ংকর বিষাক্ত কথাগুলো… আবেগমথিত কিন্তু পষ্ট গলায় সায়নতারা বলছিল ” ও যখন বলে তোমার সাথের সেই অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কথাগুলো আমার ভিতর তোলপাড় করে, আমি কইতে পারি না আমি সইতে পারি না, এক অসহ্য যন্ত্রণা ও দুর্দমনীয় কামনা আমায় পাগল করে তোলে। বল তুমি, বলে দাও আমায় আমি কি করে বাঁচব… আমার প্রতিটি রাত যে বিষিয়ে যায়, আর কি কিছুই করার নেই, ও তোমার বর্তমান কিন্তু ও না জানলেও তুমি তো জান আমি তোমার প্রথম… ” কথাগুলো যেন কান্নার আবেগে কেঁপে ওঠে…

বিশ্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল বিশাখা, কাকে এমন করে বলছে সায়নতারা! সে জানে না এমন কে আছে সায়নতারার জীবনে, অবাক হয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বিশাখা দোর ধরে আর তখনই স্তব্দ হয়ে গিয়েছিল… মেঝেয় আবেগ বিহ্বল দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে সায়নতারা আর চেয়ারে বসে মুগ্ধ দৃষ্টি অপলক নয়নে ওর পানে চেয়ে আছে… রূদ্র…! তার কোলে তার প্রিয় নোটবই খোলা, বিশাখার দেওয়া রূদ্রের আদরের কলম পায়ের কাছে অনাদরে পড়ে আছে! পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছিল বিশাখার। দরজাটা না ধরলে যেন পড়েই যেত… দরজার শব্দে তাকাল সায়নতারা তার মুখে সলজ্জ হাসি, নরম গলায় বলল “আয়”।
আর রূদ্রের তো হুঁশই ফেরে নি… সে কেমন গলায় বলল ” ভাবতে পারি নি। ” ততক্ষণে বিশাখা ভেবে নিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে পাগলের মতো দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায় চলে এসেছে। এতক্ষণ বাদে সে রূদ্রের গলা পেয়েছে ” এই সোন্টাই কি হল! শোন কোথায় যাচ্ছ? ” বারান্দায় ঝুঁকে দাঁড়িয়ে সায়নতারা বলছে ” শোন বিশাখা শোন, এই রূদ্র ফেরাও ওকে। ”

সামনের চলন্ত ট্যাক্সি থামিয়ে উঠে পড়ল বিশাখা.. বাড়ি যাবে না… এখনই রূদ্র নয়ত সায়নতারা গিয়ে হাজির হবে… মোবাইল তুলে বাড়িতে জানিয়ে দিল আজ সে ফিরবে না, কোন চিন্তা নেই ছন্দাদের বাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু ট্যাক্সিওয়ালাকে বলে ফের গাড়ি উলটো দিকে ঘুরিয়ে চলে গেল বুলিপিসির বাড়ি, একা মানুষ, ফাঁকা বাড়ি। তার একটু একলা থাকার দরকার। বুলি পিসি শান্ত স্নেহশীল মানুষ কিন্তু খুব কম কথা বলেন।
সারারাত হিস্টিরিকের মতো একা ঘরে কেঁদেছিল। মোবাইল অফ করে দিয়েছিল।

রাতারাতি শান্তিনিকেতনে আনন্দ স্যারের সাথে কথা বলে চলে যাবার ব্যবস্থা করেছিল। ভাগ্যিস মা আর নেই, বাবাইকে ফোন করে বলেছিল ” বাবাই আমার বড় কষ্ট হচ্ছে, আমি এখানে থাকলে পাগল হয়ে যাব হয়তো ভুলভাল কিছু করব, হয়তোবা মরেই যাব। আমি বাইরে যাচ্ছি, তোমায় ফোন করব রোজ কিন্তু জায়গাটা জানাচ্ছি না যাতে তোমায় কেউ জোর করতে না পারে… বাবাই তুমি কষ্ট পেও না… আমি এতেই ভালো থাকব। ”

অনেক্ক্ষণ ওদিক থেকে উত্তর আসে নি, তারপর দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বৃদ্ধের উত্তর এসেছিল ” আচ্ছা মা, যেখানেই থাক ভালো থেক। ”
মোবাইলটা বুলিপিসিকে দিয়ে দিয়েছিল, পিসির নিজের ফোনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। নতুন মোবাইল, নতুন নাম্বার নিয়ে, এক রাতে আচমকা বাড়ি কিছু দরকারী কাগজপত্র কার্ড নিয়ে চলে গিয়েছিল। আর কোন খবর নেয় নি ওদের। বাবাইকে ফোন করত বাইরে থেকে রাতের দিকে, আলাদা আলাদা সময়ে।
নয়নতারা কিন্তু খুঁজে বার করেছিল বুলিপিসিকে, আসলে ও যে অনেক অনেক জানত বুঝত বিশাখাকে। দুদিন বুলিপিসিকে দিয়ে এমনিই ফোন করিয়েছিল তারপর এই ফোন…

বিশাখা তো ভুলতেই চেয়েছিল কিন্তু কেন ওরা খোঁচায় কিচ্ছু শোনার নেই আর.. পনেরোদিন বাদে বাবাইয়ের ফোনে ফোন করতে বাবাই খবরটা দিয়েছিল সায়নতারার সাংঘাতিক এক্সিডেন্ট হয়েছিল , বাঁচার আশা নেই। এখনো হাসপাতালে…কোন জ্ঞান নেই। ওর মা পাগলের মতো হয়ে গেছেন। আর পারে নি বিশাখা, সব মান অভিমান ভুলে ছোটবেলার সাথীর কাছে ছুটে এসেছিল।
চোখ খোলে নি সায়নতারা। জাগে নি সে… নেমে এসেছিল ভিজিটিং আওয়ারের শেষে নিচে বসেছিল রূদ্র শুকনো মুখ, উস্কোখুস্কো চুল, তাকে দেখে অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। রাগে আবার জ্বলে উঠেছিল বিশাখার মন। রূদ্র এসে তার এতদিনের বন্ধুকে কেড়ে নিল তার থেকে, বিষাক্ত করে দিল সম্পর্ক টাকে, সায়নতারা কি আর কথা বলবে তার সাথে?

ফেরার পথে সায়নতারাদের বাড়ি গেল বিশাখা,কাকিমাকে দেখতে, তার মার মতো উনি। তবে সেই বিষাক্ত দিনের স্মৃতিটা নাড়া দিচ্ছিল তাকে। পাগলের মতো কাঁদছেন কাকিমা… ” কি যে হয়েছিল মেয়েটার তুই চলে যাবার পরে, পাগলের মতো করত, খেত না ঘুমুতো না… সবসময় অন্যমনস্ক… এই অনমনাই কাল ডেকে আনল রে। ” মুচড়ে উঠল বুকের ভিতর । কাকিমা বাথরুমে যাবেন, বিশাখার বুক কষ্টে অভিমানে ভরে যাচ্ছিল। সে সায়নতারার জন্য শত রূদ্র ছেড়ে দিতে পারে হাসিমুখে কিন্তু ওরা ছলনা করল কেন, লুকোচুরি করল কেন? কাকিমাকে ধরে ধরে উঠোনে নামাল, বাথরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। ঠিক তখনই উপরের বারান্দা থেকে বিশাখার গায়ে এসে কি একটা পড়ল। চমকে উঠে দেখল উপরের টবের চন্দ্রমল্লিকা… উপরে তাকাল একবার! একি! ওখানে কে দাঁড়িয়ে? কেউ তো নেই বাড়িতে… ওকে বসিয়ে কাজের দিদি ওষুধ আনতে গেছে দোকানে। আবার তাকাল একি দেখছে সে! সায়নতারা! পড়ার ঘরের দিকে যাচ্ছে… অসম্ভব কিন্তু ভুল তো নয় সে আবার ফিরে তাকাল বিশাখার দিকে। চোখমুখ দেখা গেল না স্পষ্ট কিন্তু সায়নতারাই। কাকিমাকে ঘরে শুইয়ে সে ছুট্টে উপরে গেল। কেউ নেই কোথাও , পড়ার ঘরের আলোটা জ্বালল, আবার চোখে জল এসে. গেল, টেবিলে তাদের দুজনের ছবি সেই ছোটবেলাকার… মনের ভুল! চোখ মুছে আলোটা বন্ধ করে বেরিয়ে আসার সময়ই ওড়নাটা কে টেনে ধরল। চমকে গেল বিশাখা… না চেয়ারের হাতলে আটকে গেছে ওড়না! আলতো করে ছাড়িয়ে নিয়ে পিছন ফিরতেই আলমারির মাথা থেকে কি একটা পড়ল তার পায়ের কাছে, নিচু হয়ে তুলে নিল বিশাখা সায়নতারার লেখার তাড়া, কোন নাটকের। ফিরে এসেছে কাজের দিদি, নিচে নেমে এল বিশাখা। কাকিমা বসতে পারছেন না, গায়ে কম্বল চাপা দিয়ে শুলেন। বিশাখা আজ থেকে যাবে এখানে বাবাইকে জানিয়ে দিয়েছে।
খুলে বসল লেখাটা , কয়েকটা পাতা পড়ল, বড় ভালো লিখত সায়নতারা, ডুবে গেল লেখায়।

একটা মেয়ের ডিভোর্সের পরের নানা মানসিক যন্ত্রণা। তারই এক ঘনিষ্ঠ অফিসের বান্ধবীর কাছে শোনে তার সদ্য বিবাহিত জীবনের আনন্দ প্রেম সুখের গল্প। না পাওয়ার যন্ত্রণায় ছটফট করে মেয়েটি। শেষে একদিন জানতে পারে তারই প্রাক্তন স্বামীর সাথেই বিয়ে হয়েছে তার বান্ধবীর। একদিন ফাঁকা বাড়িতে মুখোমুখি হয় দুজনে তারপর……পাথর হয়ে যায় বিশাখা এসব কি লেখা আছে…এ কোন ডায়ালগ। সেই কথাগুলো যেটা সেদিন বলেছিল সায়নতারা..! শেষ পাতাটা আগে দেখে নেয়। লাল কালি দিয়ে লেখা শর্টফ্লিমের জন্য…

আবার দুনিয়া কেঁপে ওঠে, এ সে কি জানল… কি বলতে চেয়েছিল সায়নতারা… ফোনটা তখনই আসে নার্সিংহোম থেকে কাজের দিদিকে চাইছে… ধরল অবশ্য বিশাখা…রূদ্রর গলা ” ও আর নেই… চলে গেল। ” অন্ধকার হয়ে গেল পৃথিবী বিশাখার। রুদ্র এসে দাঁড়িয়েছিল তার সামনে… চোখ তুলে তাকাতে পারে নি বিশাখা…তাকাতে পারে নি কাকিমার দিকেও। সে চলে যাবে… সে আর এখানে থাকতে পারবে না।

নার্সিংহোমে তিনদিন পরে চোখ খুলল বিশাখা।বেশ ভালোই বুঝতে পারল যাওয়া তার হয় নি, সে সায়নতারাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল তাই আজ সায়নতারা তার কাছে থাকবে না। ফিরিয়ে দিয়েছে। নইলে অতগুলো ঘুমের ওষুধ কাজ দিল না… একরাশ অপমানের মধ্যে সে রয়ে গেল… কে কাঁদছে অমন করুণ করে, ঝুঁকে পরা বৃদ্ধা কে!… কাকিমা…! এমন হয়ে গেল এ কদিনে! ” তোরা কি নিষ্টুর রে, একবারও বুড়ো-বুড়িদের কথা ভাবিস না… বন্ধুর শোকই এত বড় হল…!”
কাকিমা মা ভাবছে সায়নতারার শোকে সে… লজ্জা কি লজ্জা… কেন মরে গেল সায়নতারা? কার জন্য? না চাইতেও চোখ চলে গেল রূদ্রের দিকে… চোখ বুজে নিল। ওই নিয়ে এসেছে কাকিমাকে…

শুনল রূদ্র বলছে কাকিমাকে ” দেখ আবার বাড়াবাড়ি হলে কিন্তু আমি বিপদে পড়ে যাব, সায়নের শর্টফ্লিমটা কিন্তু শর্টফ্লিমফেয়ারে যাবে। আমি যদি তোমাদের নিয়ে বসে থাকি তবে তো সায়ন তার যোগ্য মর্যাদা পাবে না… সেরে ওঠ সব। কাকিমা তোমার দায়িত্বটা বিশাখা নিলেই আমি কাজটায় মনপ্রাণ ঢেলে খাটতে পারব। এতক্ষণ পরে জোরে জোরে কেঁদে উঠল বিশাখা।কান্নার ঢেউ আছড়ে পড়ছে বুকে। ঝাপসা চোখে তাকাল জানলার দিকে, কাঁচের ওপারে সায়নতারা দাঁড়িয়ে আছে, সে স্পষ্ট যেন দেখতে পেল! ওর মুখে কি হাসি…!

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments