রামায়ণের রাবণ এবং মাইকেলের রাবণ:একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ – রাজু বিশ্বাস
সাহিত্য সময়ের ফসল। কালে কালান্তরে সাহিত্য বিচারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়। প্রাচীন কালে রচিত কোনও সাহিত্য কর্মের যখন নব নির্মাণ হয় তখন খুব স্বাভাবিক কারণেই আধুনিক কালের চিন্তা চেতনা বোধ সে সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়। বাল্মীকি ‘রামায়ণ’ –এর ‘যুদ্ধকাণ্ডে’র ৮৫ থেকে ১০১ সর্গে বর্ণিত অংশটুকু সূত্রাকারে গ্রহণ করে মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর বিখ্যাত ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ সৃষ্টি করেছেন। এই দুই কাব্যেরই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য চরিত্র রাবণ। মাইকেল তাঁর কাহিনি বয়নে মূল রামায়ণকে অনুসরণ করলেও চরিত্র নির্মাণে যথেষ্ট স্বাধীনতা গ্রহণ করেছেন। নবজাগরণের প্রভাব তথা কবির অসাধারণ প্রতিভার স্পর্শে বাল্মীকি রামায়ণের খলনায়ক রাবণ ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ নায়কের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছেন। বস্তুত রামায়ণ হল আদি মহাকাব্য এবং মেঘনাদবধ আধুনিক কালে সৃষ্ট একটি উৎকৃষ্ট সাহিত্যিক মহাকাব্য। রামায়ণে যে রাবণ চরিত্রকে পাই তিনি তাঁর থেকে মধুসূদনের রাবণ বহুলাংশে পৃথক। বাল্মিকির রাবণ পরম অধর্মাচারী কপট বিভীষিকা-রূপী রাক্ষস। রামায়ণে তাঁর পাপী চরিত্র চিত্রণের প্রয়াসই দেখা যায়। সেখানে রাবণ পাপ ও অধর্মের প্রতিমূর্তি। তাঁর পথে চললে মানুষের বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। রাম ধর্ম এবং রাবণ অধর্ম। এহেন রাবণের ভিতর যে শ্রদ্ধার যোগ্য কিছু থাকতে পারে তা মধুসূদনের আগে অচিন্তনীয় ছিল। কিন্তু শুধুমাত্র ধর্মাধর্ম, পাপ-পূর্ণের মানদণ্ডে বিচার করলে মাইকেল সৃষ্ট রাবণের প্রতি সুবিচার করা হবে না। মধুসূদনের রাবণ অসভ্য বর্বর রাক্ষস নয়, বরং এক বিশেষ সংস্কৃতি সম্পন্ন বীরপুরুষ। রাক্ষস জাতির শক্তিশালী অধিনায়ক। কিন্তু সব কিছু ছাড়িয়ে বড় হয়ে উঠেছে তাঁর স্নেহপ্রবণ দায়িত্বশীল পিতৃহৃদয়। রাবণের রাজসভার বর্ণনা থেকে বোঝা যায় তিনি কেবল অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী নন, সভ্য মার্জিত কৃষ্টি ও রুচি সম্পন্ন মানুষ। রামায়ণে রাবণ নিছক এক রাক্ষস রাজা। মানুষ নন। কিন্তু মেঘনাদবধ কাব্যে রাক্ষস শব্দকে সঠিক অর্থে প্রয়োগ করেছেন মধুসূদন। ‘রাক্ষস’ শব্দটি এসেছে ‘রক্ষ’ শব্দ থেকে। অর্থাৎ যিনি রক্ষা করেন। রাবণ কেবল তাঁর ঔরসজাত সন্তানদের নয়, সমগ্র লঙ্কাবাসীকে সন্তান-জ্ঞানে রক্ষা করতে চেয়েছেন, তাই পুত্রশোকের সঙ্গে তাঁর পিতৃহৃদয় সমগ্র লঙ্কার শহীদ বীর সন্তানদের জন্য শোকে আকুল হয়ে উঠেছে। রামায়ণে রাবণের করুণ পরিণতির জন্য পাঠকের হৃদয়ে কোনও ব্যথা অনুভব হয় না, কিন্তু মেঘনাদবধ কাব্যের রাবণের ট্রাজেডি পাঠককে কাঁদায়। রামায়ণের রাবণও কেঁদেছে। কিন্তু সে কান্না পাঠক আনন্দে উপভোগ করে, কারণ পাঠকের দৃষ্টিতে পাপী তাঁর পাপের সমুচিত ফল পেয়েছে। অপমানিতা ভগিনী শূর্পণখার অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার কারণে সীতাহরণ জনিত অপরাধ যতই সমাজের নীতি বহির্ভূত কাজ হোক না কেন তাতে রাবণকে পাপী বলা যায় না। কারণ লঙ্কায় অশোক বনে রাবণ কখনো সীতাকে অসম্মান বা অশ্রদ্ধা করেনি। রাবণ চাইলেই অনায়াসে তা করতে পারত। তবু এই বিষয়টুকু বাদ দিলে মেঘনাদবধ কাব্যের রাবণ কেবল একজন রাজা নন, পুত্রবৎসল পিতা, স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষায় দৃঢ়সংকল্প সম্রাট, স্নেহাপ্রবণ ভাই, পত্নীপ্রেমিক স্বামী এবং সর্বোপরি একজন শক্তিশালী যোদ্ধা। অপর দিকে রামায়ণের রাবণ একজন দেব বিদ্বেষী, অহংকারী, শাস্ত্র ও নীতিজ্ঞানহীন , নারীলোলুপ, অপহরণকারী প্রতারক চরিত্র। মধুসূদন রাবণ চরিত্রকে নিজের মতো করে নির্মাণ করলেও তিনি মূল রামায়ণের রাবণ চরিত্রকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে তা করেননি। মূল কাব্যের কাহিনিকে অক্ষুণ্ণ রেখেই তিনি রাবণ চরিত্রে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছেন। আধুনিক মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে রাবণ চরিত্রকে বিচার করে রাবণের চরিত্রের প্রকৃত সত্যকে পাঠকের সামনে উন্মুক্ত করে তুলে ধরেছেন। এ জন্য রামায়ণের রাবণের সঙ্গে মেঘনাদবধের রাবণের মধ্যে প্রকৃত অর্থে কোনও বিরোধ নেই। বাল্মীকি রাবণের হিংস্রতা উগ্রতা কপটতাকে তুলে ধরতে গিয়ে রাবণের মানব হৃদয়কে অস্বীকার করে রাবণের প্রতি যে অবিচার করেছেন মাইকেল যেন দীর্ঘ কাল পর অপরাধী রাবণের কেস আবার ‘রিওপেন’ করে তাঁর চরিত্রের কলঙ্ক মোচন করেছেন। প্রায় বিনাদোষে সাজাপ্রাপ্ত রাবণকে কার্যত নির্দোষ প্রমাণ করেছেন। এখানেই রাবণ চরিত্র নির্মাণে মূল কবি বাল্মীকিকেও যেন অতিক্রম করে গিয়েছেন কবি মধুসূদন দত্ত।