Homeমুক্তমতআমার শিক্ষক, আমার সাঁই - স্বকৃত নোমন

আমার শিক্ষক, আমার সাঁই – স্বকৃত নোমন

আমার শিক্ষক, আমার সাঁই – স্বকৃত নোমন
ঈদের দিন কিংবা ঈদের পরদিন চোরাইপথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইন্ডিয়া গিয়ে সিনেমা দেখাটা ছিল আমাদের জন্য অবশ্যকর্তব্য একটি বিষয়। মাওলানা সাহেব সেটা জানতেন। তাই প্রতি ঈদের নামাজের আগে মুসল্লিদের উদ্দেশে তাঁর বয়ানে তিনি বলতেন, ‘ঈদ আপনাদের কাছে ধর্মীয় উৎসব। কিন্তু এই মাঠে এমন ছেলেপিলেও আছে, যাদের কাছে ঈদ মানেই ইন্ডিয়া গিয়ে সিনেমা দেখা। কারা ওপারে গিয়ে সিনেমা দেখে আপনারা জানেন। নাম বলব না। আপনারা তাদের চেনেন। এই ময়দানেই তারা উপস্থিত আছে। সারা মাস একটাও রোজা রাখেনি, দোকানপাটে গোপনে বসে খেয়েছে। এখন তারা নামাজ পড়তে এসেছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে নামাজের আগে তারা অজুটাও করেনি। তাদের মাথায় মাস্তানদের মতো লম্বা চুল, তারা জিন্স পরে, সিগারেট খায়। আল্লাহ তাদের হেদায়েত করুক। বলেন আমিন।’
আমরা, মানে আমি ও আমার বন্ধু আমান মাথাটা নিচু করে রাখতাম। একবারের জন্যও তুলতাম না। কেননা মাওলানা সাহেব বর্ণিত লম্বা চুলের জিন্স পরা ও সিগারেটখোর তো আমরা দুজন। মনে হতো, শত শত চোখ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মাথা তুলব কেমন করে!
নামাজ শেষ হতো। মাওলানা সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। গ্রামবাসী তরুণ-যুবকের দল সার বেঁধে তাঁকে কদমবুচি করছে, সমবয়সীরা তাঁর সঙ্গে কোলাকুলি করছে। আমরাও লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁকে কদমবুচি করতে গেলাম। তিনি আমাদের মাথায় হাত রাখলেন। আমরা তার হাতের কাঁপুনি টের পেতাম। কদমবুচি করে উঠে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতাম তিনি কাঁদছেন। তাঁর গাল ভেসে যাচ্ছে, গলা ভেসে যাচ্ছে অশ্রুতে। আমাদের কান্না পেত না। কখনো পায়নি। অপরাধবোধও জাগত না। আমরা মাথা নিচু করে তার সামনে থেকে চলে আসতাম।
তেরো বছর হয়ে গেছে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমার ঈদ-আনন্দেরও মৃত্যু ঘটে। আমি আর কখনো ঈদগাহে যাইনি। কেননা ঈদ মানেই তো তাঁর উপদেশ। ঈদ মানেই তো তাঁর নিষেধ অমান্য করা। যাইনি, কেননা নামাজের পরপরই বিস্তর মুসল্লির সঙ্গে সার বেঁধে তাঁর কবরের সামনে দাঁড়াতে হবে। সেই দাঁড়িয়ে থাকাটা বড় বেদনার। ওটা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। সেই অসম্ভবের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারব না বলে ঈদে কখনো গ্রামের বাড়ি যাই না। একাকী দরজা বন্ধ করে রবীন্দ্রনাথের গান শুনি। এটাই আমার আনন্দ।
বরং যাই গভীর বর্ষার রাতে, যখন তাঁর সমাধি থেকে ভেসে আসে কদমের ঘ্রাণ। যাই কোনো এক গভীর নিঝুম শীতরাতে। তখন সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ টের পাই তাঁর উপস্থিতি। টের পাই, তিনি মাথায় হাত রেখে বলছেন, ‘দুনিয়ার সম্পদের পেছনে ছুটে জীবনটাকে বরবাদ করে দিও না বেটা, জ্ঞানের পেছনে ছুটো।’
সেই মাওলানা আমার পিতা, আমার শিক্ষক, আমার সাঁই।
মহাকালে রেখাপাত
১৩ মে ২০২১
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments