Homeসাহিত্যমেঘরেণু -সুদীর্ঘ এক বনপথ - অমিতকুমার বিশ্বাস এর মুক্তগদ্য

মেঘরেণু -সুদীর্ঘ এক বনপথ – অমিতকুমার বিশ্বাস এর মুক্তগদ্য

মুক্তগদ্য:
মেঘরেণু—সুদীর্ঘ এক বনপথ
অমিতকুমার বিশ্বাস

এই যে বুকে বিঁধে আছে আধখানা প্রেম ছোঁবলের মতো উদ্ধত গোপন, এই যে প্রতিটি রাতচাদরে ঢেকে রেখেছ সাদাপৃষ্ঠা আর নিঃসঙ্গ ঝুলবারান্দা, এই যে শপিংমল থেকে নেমে এসে সটান ঢুকে গেলে পাইথন-পেটে— এর থেকে দূরেই বিছিয়ে রেখেছি আমার অন্ধ সাঁকো আর লেফাফার মুমূর্ষু আত্মজীবনী। গাছেদের সঙ্গে গভীর সম্ভোগ সেরে গাছেদেরই স্তনে মুখ রেখে দিয়েছি সুদীর্ঘ সনাতন ঘুম। জোছনা-আঠায় ছুঁয়ে-থাকা বোধ এখনও সাগর-সতেজ। মরুরাতে কেবলই সজারু জেগে থাকে বিষাদশিশিরে। পেন্ডুলামে ক্ষত কিংবা দীর্ঘ রেলপথ। অথচ এখনও নির্বিকার তুমি বিছানায় আতসকাচ মেলে খুঁটে খাচ্ছ নিরীহ পাখিদের উপাখ্যান। পৃথিবীর সড়ক দিয়ে ভালোবাসা হেঁটে গেলে হবে এক মহাবৃক্ষরোপণ— এমনই তো কথা ছিল সব। আজ মড়ক লেগেছে ছায়ায়। বন্ধু, তোমাদের বাঁশিতেও কি এমন বিষাদঝড়, এই অবেলায়?

শ্রাবণ মানে তোমার নীল ছাতাটা উড়ে যায় দূরে সহসা। পোষা বেড়ালের মতো করুণ ভেজা বাতাস মুখ ঘষে পায়ে। এ-পায়ে প্রেম ছিল। আলতার মতো গ্রামীণ ছড়াও ছিল বেশ। এখন স্পর্শকাতর মুঠোফোন কেঁপে ওঠে পরিচিত রোগীর মতো। শ্রাবণ মানে এখন আমাদের সুদীর্ঘ নীরবতা পালন। রাত্রি-উড়োজাহাজের হৃদয় থেকে যে সংকেত টুপ করে নেমে আসে ঘাসপরীর দেশে, সেখানেই পাখিদের সুনীল ঘুম হয়ে হারিয়ে যাবার স্বপ্নটা আজ সহসা লোপাট মুতসুদ্দি-মুশায়রা আবেগে!

শেষমেশ মহানাগরিক বিবাহ-আয়োজনে বুঝি মেঘেদের ধূসর সন্তানেরা আমাদের কেউ ছিল না কখনও। অসংখ্য আলোকপ্রপাতের নীচে ভেসে যাওয়া স্বপ্নপাখির মতো শোনো এই গোধূলিবিলাপ! দেখো, সাবমেরিনে ফিরে আসে মৃত কুয়াশার শরীর। মাথায় আস্ত সেতার নিয়ে নেমে-পড়া জোছনাপ্রলাপের পাশে পড়ে থাকে হলুদ চিঠি। কালো আকাশের ওপাশ থেকে ভেসে-আসা মহালয়ায় আজও জেগে উঠবে কেউ, আজও চোখের জল লুকিয়ে রাখবে ঘাসের ডগায়, আর সবার অলক্ষ্যে তাদের লুফে নেব মনোহর স্মৃতিকোশে।

আমরা ভুলেছি অলস দুপুরে হেলান দিয়ে প্রেমপত্র-লিখন। ভুলেছি বৃষ্টি কিংবা গাছপালার গাঢ় আদর। আমাদের পিওন কুমিরের পিঠে চড়ে পোহাচ্ছে রোদ। আমাদের ডাকঘরে প্রাচীন বাইসনদের ছালচামড়া, যেন মায়াবী ভাষা থেকে উপড়ে নিয়েছে দু-চোখ !

এই জোছনায় দেখি কাশফুলের মতো কিশোরী হাসিতে ফসলের বুক ছুঁয়ে উড়ছে বাতাস। পাতায়-পাতায় ছাঁকনির পর যে বিশুদ্ধ চন্দ্রালো মায়াবী হরিণের মতো এসে সহসা সামনে দাঁড়ায়, তার মুখের মতো প্রেম নেমে আসুক দেশে। এইতো আমার বাড়ি, এইতো বাড়ির সামনের আনমোল ক্যানভাস। ঘর থেকে উঠোন থেকে ছাদ থেকে রোজ হাত বাড়িয়ে দিই এইখানেই, আর বারে-বারে ছুঁয়েফেলি সেইসব ফেলে-আসা প্রেমিকাদের অলৌকিক নীলচুল কিংবা ঘুমন্ত ঠোঁটের মায়াকম্পন।

এই যে রাখালের কৌতূহলের মতো সন্ধ্যা নেমেছে আমাদের মেঘমাটিপুরে, তাকে কি কখনও ছুঁয়ে দেখেছ মাথার ভেতর সদা-উড্ডয়নশীল ফড়িং-হৃদয় দিয়ে? যেসব রঙিন মেঘেরা তোমার ঠোঁটে এঁকে দিত নদীমাতৃক সভ্যতা, তারাও ক্রমশ লোপাট হয়ে যাচ্ছে আকাশগঙ্গা থেকে। জোছনার পেট ফুঁড়ে আজ যতসব অবৈধ হৃদয়ে ভরে ওঠে প্রসূতীঘর। এই অন্ধ সাঁতারপথে ছুঁয়েছি কেবল সময়ের উগ্র স্তনবিভাজিকা আর কৃত্রিম যোনিকম্পন। মিঠাপাতার আড়ালে রেখে গেছ যত বেদনাগুচ্ছ, এখনও আমার জিভের ‘পর তার মিঠা স্বাদ অমলিন। এখন তোমার সতেজ চোখে চালিয়াৎ তৈল-বিজ্ঞাপন। এখন সাপও লাফাচ্ছে বেকুব স্বপ্নঘোরে। এখন ফেয়ারনেস ক্রিম মেখেই নেমে পড়লে গান্ধীমূর্তির পাশে স্রেফ কয়েকজন সফেদ আম-আদমিদের সবক শেখাবে বলে। কী আর করি বলো! আমার জন্য থাক এই বিজ্ঞাপনহীন বনপথ যাপন আর কয়েকটি বুনোহাঁস।
স্বপ্নসম্ভব বাতাসে আকাশের মিহি গুঁড়ো — যেন ভাঙছিল মেঘবাড়ি নিমেষেই। ঘোড়ার খুরে বিষাদ। হরিণের চোখে মায়াহীন দ্বীপ। পাখিদের ডানায় ভেঙে-পড়া চাঁদ। চাঁদের লালায় বসে শুধু ভাবি — মৃত্যু এক অলৌকিক নীল ছায়া।
অবশেষে ঘুমে ঢলে পড়ছে মেঘগুলো। অথচ তুমি এখনও জোছনার খোঁজে রাজপথে। এখানে চাঁদবুড়ির আত্মহননের পর পাড়ার ছেলেরা মেতেছিল ওরাংওটাং সাজে। তুমিও তো নেচেছিল বেশ। তুমিও হাততালি দিতে-দিতে পেঁয়াজের খোসার মতো হারিয়ে ফেলেছিলে সাধের আঙুলগুলো।
এখন আমার আত্মায় ছুঁয়ে-যাওয়া-আদর কিনে নিচ্ছে অনলাইন।

তবুও তোমার অনন্ত শরীর থেকে ছড়ানো আলোয় ধুয়ে নিচ্ছি আমার অন্ধত্ব। তোমার সঙ্গে হাঁটতে চাই মেঘরেণু— একটা গুহাপথ কিংবা শিশুদের অনন্ত হাসি পর্যন্ত। নিজেরাই জানি না ঠিক কী চাই— ঠিক কী চাওয়া উচিত আমাদের। জানলে আর এভাবে মিছি-মিছি খড়গাদায় আগুন লাগাত না কেউ। নিজেরাই নিজেদের নায়ক কিংবা এক আন্তরিক ভিলেন। নিজের সঙ্গে নিজের রোজ জুয়াখেলা জোরদার। নিজেকে নিজেই হারানো কিংবা তুমুল হাততালি দিয়ে জিতিয়ে দেওয়া শেষমেশ। নিজের কাঁধে নিজেই মাথা রেখে একটুখানি কাঁদা, আবার একটু সাট-সাট আদর। প্রতিনিয়ত এই পরিকল্পিত আড়ি-ভাবের খেলায় মেতে-ওঠা পৃথিবীতে মাঝে-মাঝে নিজেকে গোছানো জোকার মনে হয়।

রাতপোশাক সরিয়ে এখন নগ্ন পায়েই মাঠ পার-হওয়া। ওপাশে কালুপুর, ওপাশেই তোমার দেশ। ওপাশ থেকে মেঘ আসে বৃষ্টি আসে বাতাস আসে। মা বলতেন— দ্যাখ তো আকাশটা। দেখতাম, কালুপুরে মাতাল মেঘ লাঠিসোঁটা নিয়ে রে-রে তেড়ে আসছে মাঠের ফসল লুটে নিতে! আমরা হুহু করে ছুটে এসে উঠোনের সেদ্ধ ধান তুলে ফেলতাম ঝটাপট, কিংবা তুলতাম নেড়ে দেওয়া পাটগুলোও। মাঝে-মাঝেই স্কুলে যাওয়া লাটে উঠত আমাদের। পরদিন গেলে সে কী মার! বুঝবেন কীকরে স্যার, কিংবা তুমিও, মেঘরেণু—আমাদের নখের নীচে জেগে ছিল আরও একটা সবাক মানচিত্র, চোখের নীচে ভাসমান দ্বীপ— কেবল সেসব লুকিয়ে রেখেছি নির্মম গোপনে।

পেছনে সুবিশাল বাঁওড় বর্ষার জলে রগচটা। ওখান থেকেই শুরু গাছপালার মিছিল। তার মধ্যেই পথ। পথপাশে পাখিরা রেওয়াজে বসেছে আজও। শরৎ এসে গেছে। পাখিদের মন্ত্রে ঈশ্বর আসবেন আকাশ থেকে নেমে— এখানেই। এখানেই মাটিজন্ম। এখানেই মহালয়া। সেই একই কাহিনি, সেই কবে থেকেই মাটির পাতাতে লেখা। অথচ কত নতুন, কত তরতাজা! ভোরবেলা ঘাসের বুকে ঘুমিয়ে-পড়া শিউলিঘ্রাণের মতোই যেন।

নকফুলের দিকেই কি আজ তুমি? এরকম কত কত সুন্দর গ্রাম আশেপাশে। আজকাল ‘ফুঁ দিয়ে উড়াল ভেঙে দিই’। আরও অনেক কিছুই দিয়েছি যে— পুড়িয়ে, উড়িয়ে — তোমাকে, এবং নিজেকেই। বেশ ভালো লাগে ক্যানিবাল হতে। তুমিও তো অবশেষে পাতাল রেলের কোলন হয়ে শ্বাসরোধকারী বিছানায় ছুটে চলেছ নেবুলাইজার হাতে। অবশেষে ছিটকে যাও কমোডে, যেখানে আইকম-বাইকম সকল সম্পর্ক পাক খেতে-খেতে গেয়ে ওঠে পাঁচ সিঁকি পাতি ফিল্মিগান।

ঢের হয়েছে। আমার এসব চাই না আর। আমার জন্য থাকুক কয়েকটি মেরুদণ্ডী তালগাছ আর বাতাস ভর্তি ফুসফুস, যাতে তোমার সকল শব্দের মুখে দাঁড়িয়ে বলতে পারি, ফুঃ! বলতে পারি, চলো ফিরে যাই শৈশবে, শীতরৌদ্র উপুড় করা সেইসব বিভাবস্বপ্নে। চলো আজ অলস হয়ে ডুবে যাই জলে। সাঁতার জেনেও ভুলে থাকি কিছুক্ষণ, যতসময় থাকলে পরে জাপটে রাখতে পারি বুকে তোমার প্রশ্বাস।

ওই তো আমিই এগিয়ে আসছি সাইকেলে, পাশে ঝোলানো ব্যাগে আমার সংসার। ওই তো শরৎ নিয়ে আসছি ও-পাড়া থেকেই। এ-পাড়ায় এখনও মেঘ তোমার পায়ে-পায়ে বেড়ালছানার মতো মুখ ঘষে। এ-পাড়ায় রেবিসপ্রেমের পরিবর্তে হেমন্তের মতো তোমার শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়ুক অরণ্যলেফাফা— আর উড়ে যাক আমাদের অনন্ত আগামীতে।

(*’ফুঁ দিয়ে উড়াল ভেঙে দিই’—অর্ণব চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতার পঙ্‌ক্তি)

 

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments