Homeসাহিত্যময়নামতি - রত্না চক্রবর্তীর গল্প

ময়নামতি – রত্না চক্রবর্তীর গল্প

ময়নামতি
রত্না চক্রবর্তী

এক হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে ময়নামতি ভুরুর উপর হাত রেখে ঝুঁকে দেখছিল। হ্যাঁ আর একটা ঘরের চালা ভেসে আসছে জলের টানে এদিকপানে। ওটা কোনমতে ধরতেই হবে। গরু বাঁধার পুরনো মোটা দড়িটা হাতের কাছেই রেখেছিল ময়নামতি। সেটা শক্ত করে বেঁধে নিয়ে কোমরে সবল হাতে জল ঠেলে এগিয়ে চলল।স্রোত খুব কিন্তু ময়নামতি তরতাজা শরীরটাকে তেমনভাবে ঘায়েল করতে পারল না। ধরে ফেলল ভেসে যাওয়া চালাটা। চোখে পড়ল চালে গুঁজে রাখা দা’ টা। এটা বোধহয় রাবেয়াদের ঘরের চাল। দা’টা বড় চেনা, রাবেয়ার আব্বা কত্তবার ওটা দিয়ে উঠানের ডাব গাছের কাঁদি নামিয়েছে। তবে ওদেরও ঘর ভাঙলো! রাবেয়ারা অবশ্য হপ্তাখানেক আগেই চলে গেছে এখান থেকে, শুধু ওর আব্বু আর ছোটচাচা ছিল। ভাবার সময় নেই, তার গোয়াল পড়েছে ভেঙে, রান্না ঘরও। নিজের ঘরের দিকে এগোতে লাগলো, কোমরে বাঁধা দড়িটার হুকের সংগে আটকে নিল চালটা। কষ্ট হত খুব যদি না জলের টান ওদিকেই না থাকত। ঝপঝপ করে শব্দ হল, ছোট ঘরের একটা দ্যাল ধসে গেল।

বুড়ি ঘরে আছে। হাঁকপাক করে এগিয়ে চলল ময়ানামতি। বুড়ি তার বিধবা দিদিশাশুড়ি। ছেলে বৌ নাতি সব গেছে বুড়ির। বসে আছে বুড়ি চোখের মাথা, কানের মাথা খেয়ে। মাথাটা গেছে ভিমরতিতে। এখন শুধু চেনে ময়নাকে। সে যে কে তা ভুলে গেছে, সম্পর্ক মনে নেই শুধু মনে আছে ময়নামতি তার একমাত্র আপন। বুড়ি ময়নামতিকে তার বে’ র গপ্প করে, আর কত কি খেয়েছে কোনকালে তার গপ্প করে। কাঁকড়ার ঝাল, মাছের ডিমের বড়া, কচ্ছপের মাংস… শুনলে মনে হবে কত খেয়েদেয়ে তার জীবন কেটেছে কিন্তু হাভাতে বুড়ির জীবনটা কেটেছে চাল ভাজা চিবিয়ে, আধপেটা খেয়ে, শাক চচ্চড়ি ছিল একমাত্র তরকারি। কিন্তু কোনকালে বাপের আমলে, জোয়ান বরের আমলে ভালো খেয়েছে দুটো একটা দিন সেই গপ্পই তার মনে আছে। বুড়ির বর মরেছে সেই কোন জোয়ান কালে, নদীতে ডুবে নৌকা উল্টে। ছেলে মরেছে সাপের কামড়ে। বউ গেছে বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে আর নাতি সে তো গেছে বিষাক্ত মদ গিলে। আছে শুধু ময়নামতি।

তা ভালো কথা! দুঃখের কোন গল্প হয় না, সে লম্বা কাহিনী। সুখ ক্ষনিকের তাই তার গল্প কেউ ভোলে না।
ময়ানামতি কোনমতে চালাটাকে টেনে তোলে জলেডোবা রোয়াকে। তারপর ডাক দেয় ” ও বুড়ি ওঠো গো, তোমার বরের কাছে যাবা তো? সে যে তোমায় নিতে নাও পাঠাইসে।? ” বুড়ি ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। ” জাবো জবো “। চালায় বসায় ময়না বুড়িকে, পাশে রাখে মুড়কি, মুড়ির কোটো, পেলাস্টিকের বোতল ছিল ঘরে খানদুই ঘরে। ময়নার বর এনেছিল। তাতে জল ভরে রেখেছিল কুয়ো থেকে। এই বানভাসি দেশে খাবার জল তো নেই।
ঝাপাং করে ফের শব্দ ছোট ঘরটা পুরোই জলে ভেসে গেল। আর সময় নেই বুড়িকে পাঁজাকোলা করে তুলে দিল চালায়। তাপ্পর যেন ফিসফিস করে বলল ” জাও গো জাও, আপন ঘরে, দ্যাখো কপাল কোথায় নে যায়। ” দড়ি টেনে নিয়ে এল বাইরে, তারপর স্রোতের মুখে ঠেলে ভাসিয়ে দিল। তরতর করে বয়ে গেল চালা…বুড়ি একবার জিগালো ” ময়নামতি তুই আসবি নে।” কেমনতর হেসে ঘাড় নেড়ে বলল ” না বুড়ি, তোর শউরবাড়ি তুই যা।” তার গলা কেঁপে গেল। বাঁকের মুখে মিলিয়ে গেল বুড়ির ময়ূরপঙ্খী।

পিছনে হুড়মুড় করে ধসে গেল মাটির শেষ ঘরটা, আর কারো চিন্তা নেই ময়নামতির। দূরে আরো দুটো চালা ভেসে যাচ্ছে। একটায় একটা পরিবার, অন্যটা একটা গরু আর একটা কুকুর। বৃষ্টি আবার নামল। এ সব প্রায় প্রতি বছরেরই গপ্প। ময়নামতি তার সবলহাতে জল ঠেলে এগিয়ে গেল স্রোতের পানে। সাঁতার জানে ডুববে না হয়তো। বুড়ির কথা মনে হলো, বাঁচবে কি, কোথাও তার চালাটা ঠেকলে কেউ কি তুলে নেমে? কিই বা করতে পারত ময়নামতি? ঘরে ভেসে যাবেই, পঙ্গু বুড়িকে নিয়ে সাঁতার দেওয়া তো যাবে না। চোখের সমুখেই ডুবে মরবে। ময়নামতি তো সাঁতার জানে, সে তো তখন মরবে না। তবু ভাগ্য যদি বাঁচায় রিলিফের কারো চোখে পরে। আচ্ছা অবোধ বুড়ি তখন কি ময়ানামতিকে খুঁজবে ।

তেজী কন্যের গাল বেয়ে নোনা জল বন্যার জলে মিশল। ধুস! নোনা জল বাড়িয়ে কি হবে…যত্তসব উলোড়পাগল ভাবনা, এখন শুধু স্রোতের টানে ভেসে চলা।।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments