Homeমুক্তমতবাচ্চাদের সাথে সাথে আমরাও বড় হই - জাহিদ হাসান

বাচ্চাদের সাথে সাথে আমরাও বড় হই – জাহিদ হাসান

বাচ্চাদের সাথে সাথে আমরাও বড় হই
জাহিদ হাসান

‘আমি কোথা থেকে এলাম’ – এই প্রশ্ন সব শিশুই করে। প্রায় সবাই জীবনের এই প্রথম সরল প্রশ্নের গরল উত্তর পেয়ে জীবন শুরু করে। উত্তরে কী বলা উচিৎ তা নিয়ে কয়েকটি পরামর্শ আছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, প্রশ্ন এড়িয়ে না যাওয়া এবং ভুলভাল উত্তর না দেওয়া। মনে রাখতে হবে সেক্স বা বডি পার্টস নিয়ে আলোচনার অস্বস্তি আপনার, বাচ্চার নয়। আপনি বলতে যতোটা লজ্জা পাচ্ছেন বাচ্চা শুনতে অতোটা লজ্জা পাবে না। কারন সমাজ তাঁর নির্ধারিত ছাঁচে ইতোমধ্যে আপনাকে ‘লজ্জিত ও আড়ষ্ট’ করে গ’ড়ে তুলেছে, আপনি অলরেডি ‘স্পয়েল্ড’। কিন্তু বাচ্চার মন এখনো স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ। তাছাড়া তাঁরা মোটেই বোকা নয়। তাঁদের সাথে সিরিয়াস আলোচনা করা চলে। সুতরাং মিথ্যা, অবৈজ্ঞানিক তথ্যে তাঁদেরকে বিভ্রান্ত করার চেয়ে সত্যটা জানিয়ে দেওয়াই আমাদের কর্তব্য। কিন্তু তাই বলে সঙ্গম, বীর্যপাত* শুক্রানূ, ডিম্বস্ফোটন ইত্যাদি শব্দও তাঁরা বুঝতে পারবে না। তাহলে কতোটা বলবো, কিভাবে বলবো, কতোটা শুনলে তাঁরা বিশ্বাস ও সহ্য করতে পারবে?

বিদেশে দেখেছি বাচ্চাদের জন্যে “how we were born” বা “what makes a baby” ধরনের শিশুতোষ বই পাওয়া যায়। বাংলাদেশেও কিছু কিছু পাওয়া যায়। সমস্যা হলো, প্রথমত, সেগুলো বয়সভেদে উপযুক্ত নয় এবং দ্বিতীয়ত সেগুলো পড়ার পরেও বাচ্চাদের প্রশ্ন থাকবে। সুতরাং জবাব দেওয়ার প্রস্তুতির জন্যে নিচের উপায় গুলি বিবেচনা করতে পারেনঃ

১। শিশুর বয়স, ধারণ ক্ষমতা ও প্রশ্নের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করুন। তিন বছরের বাচ্চা আর ছয় বছরের বাচ্চা একই প্রশ্ন করলে একই রকম উত্তর দেবেন না। “আমি কোথা থেকে এলাম” এই প্রশ্নে একজন হয়ত বুঝিয়েছে কিভাবে পেটের ভিতর থেকে বের হলাম। আরেকজন হয়ত জানতে চাচ্ছে কিভাবে পেটের মধ্যে ঢুকলাম। অতএব, আগে প্রশ্ন বুঝে নিন।

২। চমকে যাবেন না। এমন ভাব করুন যেন এমন প্রশ্ন আর ‘জামাটা কোথায়” এমন প্রশ্ন একই রকম। এরপর পাল্টা প্রশ্ন করে আলোচনা এগিয়ে নিন। ধরুন বাচ্চা জিজ্ঞেস করলো, “আমি কোথা থেকে এলাম?” বলুন, “তোমার কী মনে হয় বলো তো? কোথা থেকে এসেছ তুমি?” এভাবে বুঝুন ইতোমধ্যে তাঁর মাথায় কোন ভুল ধারনা অলরেডি চেপে বসে আছে কি না। বা সে আসলে কী এবং কতটুকু জানতে চায়। সিরিয়াসলি শোনেন। তারপর ভংচং না বুঝিয়ে সত্যটা বলুন। যেমন, “তুমি এসেছ তোমার মায়ের পেট থেকে”। এরপর অপেক্ষা করুন। দেখুন সে পাল্টা প্রশ্ন করে কিনা। না করলে এই সেশনে আপাতত এটুকুই থাক। এক সেশনে তাঁকে সব বুঝিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। যদি জিজ্ঞেস করে, “পেট থেকে কিভাবে বের হয়েছি?” তাহলে বলুন, “ডাক্তার পেট থেকে বের করে ছোট্ট পুতুলের মতো বেবিটাকে গোলাপি একটা নরম তোয়ালের মধ্যে করে আমার হাতে দিয়েছিল” (আলোচনাটা ডাক্তার, তোয়ালে, গোলাপি, পুতুল ইত্যাদির মধ্যে একটু ডাইভার্ট করে পরের সেশনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা আর কি!)

৩। সহজ শব্দ বেছে নিন। কোন শব্দ তাঁর অপরিচিত হলে সেই শব্দের মানে বলে দিন। তাঁর নিজের ইন্টারপ্রিটেশনের সুযোগ কমিয়ে দিন। যেমন আপনি হয়ত নরমাল ডেলিভারির ব্যাপারটা এড়াতে, বললেন, ‘মা’র পেট কেটে বের করেছে তোমাকে’ কিন্তু এতে সে আরো বেশি ভয় পেয়ে গেল। কারন সিজারিয়ান ব্যাপারটা আপনি যেমন বোঝেন সে তেমন বোঝে না। বেলি আর ইউটেরাস বা ওম্ব যে আলাদা তা বুঝিয়ে দিন। নইলে সে ভাবতে পারে পেটের ভিতর খাবার পানি মল মুত্রের মধ্যে সে বোধহয় একটা মেসি অবস্থায় ছিল। বলেন যে, তাঁর জন্যে মা’র পেটের মধ্যে বরং একটা স্পেশাল আরামদায়ক ও ‘সম্মানজনক’ বাসস্থানের ব্যবস্থা ছিল। অতিরিক্ত বলবেন না আর যা বলবেন, বুঝিয়ে বলবেন।

৪। তাড়াহুড়া করবেন না। আবার ‘পরে বলবো’ বলে ঝুলিয়েও রাখবেন না। প্রয়োজনে সময় চান।

৫। সৎ থাকুন। পুরো ব্যাপারটা অস্বস্তিকর মনে হলেও শেষ বিচারে আপনি আর আপনার সন্তান। আপনার সৎ আচরণ, বাচনভঙ্গি, শব্দচয়ন ও তাঁর ব্যাখ্যা তাঁকে আশ্বস্ত করবে। দিনের শেষে জীবন আপনাদের দুজনের। অতএব সকল প্রিজুডিশ ঝেড়ে ফেলুন। জানান। নইলে সে কিন্তু হকার থেকে, চটি থেকে, পাকনা বন্ধুদের কাছ থেকে ‘জেনে’ নেবে। সেটা ভালো হবে না।

৬। উদাহরণের সাহায্য নিন। প্রাণিদের জন্মপ্রক্রিয়ার সাথে মানুষের রিলেট করে গল্প করেন। প্রানীকূলে যাঁদের বাচ্চা প্রসব হয় তাঁদের ভিডিও দেখেন একসাথে বসে। এতদসংক্রান্ত শিশুতোষ বই পড়ে শোনান। আস্তে আস্তে তৈরি করে নেন সন্তানকে। নেটফ্লিক্সে ‘বেবিজ’ নামে একটা সিরিজ আছে। দেখতে পারেন। সুইডিশ ফটোজার্নালিস্টের ফটোবুক A Child Is Born বা আমেরিকান লেখক জোয়ানা কোলের When You Were Inside Mommy বইদুটো বাচ্চার সাথে বসে পড়তে পারেন। ছবি দেখাতে পারেন। কাজ সহজ হয়ে যাবে।

৭। যদি দ্বিতীয় সন্তান হয় তাহলে তাঁকে গর্ভাবস্থায় তোমার ভাই বা বোন আসছে, সে কেমন আছে, কবে আসবে, কিভাবে আসবে, তোমার দায়িত্ব কী হবে ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত আপডেট দিন।

৮। আপনি নিজে জানেন তো ? লজ্জা পাবেন না। না জানলে জেনে নিন। দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন উপভোগ করুন।

রবীন্দ্রনাথ ‘জন্মকথা’ নামের এক কবিতায় একটা উপায় বাতলে দিয়েছেন, একটু বড় বাচ্চার সাথে এস্তেমাল করতে পারেন। সেখানে আছে

“খোকা মাকে শুধায় ডেকে–.
এলেম আমি কোথা থেকে,.
কোন্‌খানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে।
মা শুনে কয় হেসে কেঁদে.
খোকারে তার বুক বেঁধে–
ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে।”

সন্তান গর্ভে আসার আগে বাবা-মা’র ‘ইচ্ছে’ হয়ে মনের মাঝে লুকিয়ে থাকে। সেই ‘ইচ্ছে’র পরিণতিতে নারী-পুরুষের যৌনমিলন এবং তার ফলেই সন্তানের আগমন। সুতরাং প্রিয় সন্তানকে বলুন, “বাজার থেকে কিনে” না, ‘জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে” না , “হাসপাতাল থেকে চেয়ে” না; তুমি আমাদের ‘ইচ্ছে’র মধ্যে ছিলে। আমরা ভালবেসে আদর করে সেই ইচ্ছেকে (মানে তোমাকে) নিয়ে এসেছি এই দুনিয়ায়। তুমি আমাদের দুজনের ভালবাসার, আদরের আর ইচ্ছের যোগফল।

জিভের আর কানের জড়তা ভাঙ্গুক। চলুন বাচ্চাদের সাথে সাথে আমরাও বড় হই।

——————————-

*‘ইন্টারকোর্স’ ‘স্পার্ম’ ‘ইজাকুলেশন’ বাংলার জায়গায় এমন ইংরেজি শব্দ লিখে আলোচনা ‘শ্লীল’ করার ভদ্রলোকি, ইচ্ছা করেই পরিহার করলাম।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments