এ যুগের হুরমতিরা
মনিমুল হক
,,,,,,, আশি’র দশকের শেষদিকে বিটিভি-তে প্রচারিত হয়েছিল সাড়াজাগানো ধারাবাহিক নাটক সংশপ্তক। আজকের প্রজন্মের কাছে অজানা থাকলেও অন্যভাবে তারা এটি জানে, কারণ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস সংশপ্তক উপন্যাসের গল্প অবলম্বনেই এ নাটক। আমার ছবির প্রথমেই নাটকের একটি ক্লিপ দিলাম। প্রধান চরিত্র রুপায়নকারী হুমায়ুন ফরিদি এবং ফেরদৌসী মজুমদার।
____আসলে সংশপ্তক বাংলাদেশের ক্ষয়ে যাওয়া গ্রামীন জীবনের সামন্ত প্রভুদের অত্যাচার আর তার মধ্য থেকে সাধারণ মানুষের বাঁচার লড়াইয়ের এক মনোজ্ঞ পাঁচালি। আমি সেদিকে যাবো না। ভুমিকা রাখলাম মাত্র। বলবো চলমান বাস্তব প্রসঙ্গ নিয়ে অন্য একটি জীবনধর্মী কথা।
______আমার ছবিতে যে মহিলাটির ছবি দেখছেন তার নাম সাহারা বেগম। এর ডানপাশে ৮ ফিট বাই ৮ ফিটের যে টিনের ছাপরা ঘরটি দেখছেন সেটি তার আবাসস্থল। নাটোর ডিসি অফিস যেতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের সন্নিকটে নির্মাণাধীন ফোর-লেন রাস্তার পশ্চিম ধারে ড্রেনের কাছে এটি। কয়েকমাস আগে রাস্তা ভাঙ্গার সময় তার ঘরটিও ভেঙ্গে দেয়া হয়। এতে সে মোটেই চিন্তিত ছিল না। কারো কাছে ঘরটি রাখার অনুরোধ পর্যন্ত জানায়নি। রাস্তার কাজের শ্রমিকরা নিজেরাই তার এই ছাপরাটি আবারো তুলে দেয়। এখানে নেই কোন দরজা, নেই চৌকি, নেই শৌচাগার, নেই বিদ্যুৎ। মানে নীচে মাটি আর আট ফিট উপরে ভাঙ্গাচোরা টিন।
______আমাদের F&F ক্লাবের সদস্যরা প্রায়শঃই পার্শ্বের চায়ের দোকানে বসে। কৌতহলবশতঃ ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জনাব এটিএম মিরাজ আলী আজ সকালে এ মেয়েটির একটি ছোট সাক্ষাৎকার নিয়ে তার ফেস বুক আইডিতে দিয়েছেন। সেখান থেকে জানতে পেরেছি তিনি মানুষের বাসাবাড়ীতে কাজ করে মাসে ৬০০ টাকা আয় করেন, আর সে দিয়েই সংসার চলে গোটা মাস। রাতে থাকেন অন্যের বাড়ীতে কারণ শকুনীর চোখ পড়ে এখানে। এ মহিলা অন্যের সাহায্য গ্রহণ করেন না। নিতে সম্মত হন না অন্যের দেয়া শীতবস্ত্র। কথাও বলেন তার মর্জি মাফিক।
___এবার নীচের যে পুরুষটির ছবি দেখছেন তার নাম আলম। বাড়ী পাবনা জেলায়। তার বসবাসও কিন্ত এর আশেপাশে। সাহারা বেগমের তাওতো একটি ছাপরা ঘর আছে, ইনার তাও নাই। নাটোর বিএডিসি সেচ ভবনের সামনের রাস্তার ধারে ছোট একটি গাছের তলে রাত্রিযাপন করেন ইনি। কোন কাজ করেন না। অন্যকথায় তার কাজ করার কোন শক্তিও নাই। অতি ভোরে এবং রাত্রে কিছুটা উচ্চস্বরে আল্লাহ’র জিকির করতে শোনা যায় তাঁকে। কারো কাছে কিছু চায় না। তবে খাবার দিলে তা গ্রহণ করেন। ছবিটি লক্ষ্য করেন। তার গায়ে নামমাত্র একটি চাদর। আমাদের ক্লাবের নাসির নামের এক সদস্য একটি কম্বল জোগাড় করে তাকে দিতে গেলে তিনি তার চাদর দেখিয়ে বলেন,- “আমার শীত বস্ত্র আছে-অন্য কাউকে দ্যান”। তার পরেও নাসির প্রায় জোর করেই কম্বলটি তার গায়ে জড়িয়ে দেয় (নীচের ডান পাশের শেষ ছবিটি)।
,,,,,,,,আবারো একটুখানি ফিরবো সংশপ্তক গল্পে। এ গল্পের প্রধান চরিত্রে হুরমতি ও রমজান। স্বজনহারা, আশ্রয়হারা অরক্ষিত হুরমতির উপর হামলে পড়ে রমজানের মত সহস্র শকুন। এক রমজানের হাত থেকে রেহাই পেলেও লক্ষ রমজান ঘিরে ধরে অসহায় হুরমতিকে।
,,,,,,,নাটকে হুরমতির গল্প এক সময় শেষ হয় কিন্তু সাহারা বেগমদের গল্প শেষ হয় না। কোন আলমের খোজ রাখিনা আমরা। এক আলম চলে যায়- আবার সহস্র আলমের দেখা পাওয়া যায় রাস্তায়, লড়ে জীবনের জন্য। পরাজয় নিশ্চিত জেনেও মৃত্যুর আগ মুহর্ত পর্যন্ত যে লড়ে যায়- সেই তো সংশপ্তক।
_____একসময় মনে হতো ইংরেজরাই যত নষ্টের গোড়া। ওদের তাড়াতে পারলে শান্তি নেমে আসবে ধরায়। কিছুদিন পর উপলব্দি হয়, হিসেবে ভুল হয়ে গিয়েছে। আমাদের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাতে নেমে এসেছে পাকিস্তানী ভূত। কত সংগ্রাম আর রক্ত দিয়ে সে ভূতও তাড়ানো হলো।
,,,,,,,,এখন ভুপেন হাজারিকার সেই গানটি বার বার কানে বাজে,- ”বর্গিরা আর দেয়না হানা নেইকো জমিদার, তবুও কেন এদেশ জুড়ে নিত্য হাহাকার”। ভুপেন হাজারিকা খোলা চিঠি লিখেছিলেন শরৎ বাবুর কাছে। আমি কি সংশপ্তকের রচিয়তা শহীদুল্লাহ কায়সারকে কোন চিঠি লিখবো… ?
___আমি প্রথমে মানুষ, তারপরে মুসলিম
___ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য ধর্ম।