Homeমুক্তমতপ্রসঙ্গ জয়নাল হাজারী - স্বকৃত নোমান

প্রসঙ্গ জয়নাল হাজারী – স্বকৃত নোমান

প্রসঙ্গ জয়নাল হাজারী – স্বকৃত নোমান

রাজনীতির অঙ্গনে বহুল আলোচিত-সমালোচিত ফেনীর এক সময়ের সাংসদ জয়নাল হাজারী প্রয়াত হলেন। একদা ফেনীতে তিনি একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার একটি বাহিনী ছিল, যার নাম ছিল ‘স্টিয়ারিং কমিটি’, সমালোচনার মুখে পরবর্তীকালে যা ‘ক্লাস কমিটি’তে পরিবর্তিত হয়। ছাত্রজীবনে অল্প কিছুদিনের জন্য আমি তার সেই ‘ক্লাস কমিটি’তে জড়িয়ে পড়েছিলাম। তখন থাকতাম ফেনীর সোনাগাজীতে, সোনাগাজী বাজারের কাছে দেলোয়ার হোসেন ওরফে দেলু মিয়ার বাড়ির লজিং মাস্টার হিসেবে। ছাত্র শিবির একবার আমাকে খুব মেরেছিল। প্রায়ই তারা আমাকে হুমকি-ধমকি দিত। ফলে আমার একটা আশ্রয়ের প্রয়োজন ছিল, শক্তি বৃদ্ধির প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

দেলু মিয়ার বড় ভাই মাস্টার সফিউল্লাহ ছিলেন হাজারীর অনুসারী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি সোনাগাজী উপজেলা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী হলেন। আমি যুক্ত হয়ে গেলাম সফি মাস্টারের অনুসারী ছেলেদের সঙ্গে, যারা একই সঙ্গে ক্লাস কিমিটির সদস্য, যাদের কাছে সব সময় থাকত ককটেল বোমা, পিস্তল, কাটা রাইফেল, পাইপগান ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র। ফলে সতের বছর বয়সেই আমার দেখা হয়ে গিয়েছিল অনেক মারণাস্ত্র। হাজারীর শাসনকালে ফেনীতে তখন এসব মারণাস্ত্র সহজলভ্য ছিল, স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল।

সফি মাস্টারের প্রতিপক্ষ হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নোমান মিয়া। তার শক্তিও কম ছিল না। নির্বাচনের দিন দলবল নিয়ে তিনি এলেন কেন্দ্র দখল করতে। শুরু হলো সফি মাস্টার বনাম নোমান মিয়ার গ্রুপের মধ্যে ভয়াবহ গোলাগালি। গুলির শব্দে সবাই সন্ত্রস্ত্র, ভোটাররা প্রাণ নিয়ে কেন্দ্র ছেড়ে পালাচ্ছে। আমি আশ্রয় নিলাম একটি আমগাছের পাশে। একটা গুলি শাঁই করে চলে গেল আমার মাথার ওপর দিয়ে।

ভয় পাইনি। কারণ ছোটবেলা থেকেই এসব গোলাগুলি আমার দেখা। আমার জন্ম সীমান্তবর্তী বিলোনিয়ায়। অমীমাংসিত মুহুরীর চর নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ প্রায়ই যুদ্ধ লাগত। রাত-দিন চলত গোলাগুলি। বাড়িতে আমরা তখন বাঙ্কার করে থাকতাম। কখনো সপরিবার গ্রাম ছেড়ে দূরের আত্মীয়বাড়িতে চলে যেতাম। কখনো গোলাগুলির মধ্যেই ছুটতে ছুটতে আমরা চলে যেতাম সীমান্তে। বিডিআর বাহিনী কীভাবে এমজি-এলএমজি’র গুলি চালায়, দেখতে যেতাম। তবে সেদিন গুলিটি আমার খুলিতে লাগলেও লাগতে পারত। অল্পের জন্যই বেঁচে গিয়েছিলাম।

তো নামান মিয়ার জনপ্রিয়তা বেশি ছিল। কিন্তু হাজারীর প্রাথী তো সফি মাস্টার। যার যত জনপ্রিয়তাই থাকুক, হাজারীর প্রার্থীই জিতবে―এটাই তখন ফেনীর রাজনীতির নিয়ম। সন্ধ্যায় উপজেলা নির্বাচন অফিসে যথারীতি ফলাফল ঘোষিত হলো। জিতলেন সফি মাস্টার। এর কিছুদিন পর সফি মাস্টার ও ক্লাস কমিটির একদল তরুণের সঙ্গে আমিও গেলাম জয়নাল হাজারীর সঙ্গে দেখা করতে, তার ফেনীস্থ বাসভবনে। কত কত প্রশ্ন যে তখন ঘুরছিল মনে। তার সঙ্গে কথা বলার খুব ইচ্ছে ছিল। সাহসে কুলোয়নি।

বহু বছর পর, ২০১৮ কি ’১৯ সালের একদিন গণভবনে তার সঙ্গে দেখা। ইফতার মাহফিল ছিল সেদিন। দেশের বিস্তর গুণীজন উপস্থিত ছিলেন সেখানে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তখনো অনুষ্ঠানস্থলে আসেনিন। দেখলাম, এক জায়গায় একাকী বসে আছেন সাদা শ্মশ্রুমণ্ডিত জয়নাল হাজারী। আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাত তুলে সালাম দিলাম। হাজারীকে ফেনীর সবাই ‘ভাইছা’ বলে ডাকত। আমি বললাম, ‘ভাইছা, আমি কিছুদিন আপনার ক্লাস কমিটিতে ছিলাম।’ তিনি আমার দিকে তাকালেন। বললেন, ‘বাড়ি কোথায় তোমার?’

আমি আমার নাম বললাম। এবং বললাম যে আমার বাড়ি বিলোনিয়ায়। তিনি বললেন, ‘তুমি তো আমার ফেসবুকে আছ। তোমার বড় বড় লেখাগুলো মাঝেমাঝে পড়ি তো। তুমি আমার হাজারিকা প্রতিদিনে লিখতে পারো। তোমার কোনো বই পড়িনি। কী লেখ?’ আমি বললাম, ‘উপন্যাস আর গল্প লিখি। আপনার দুটি বই ছাত্রজীবনে পড়েছি। এখন হলে পড়তাম না।’
: কেন?
: বাঁধন আর বিজুকে নিয়ে বই দুটিতে আপনি যা বলতে চেয়েছেন, আপনার বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই। একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন সাংসদ এমন লিখতে পারেন, আমার বিশ্বাস হয় না।

ভাইছা আমার কাঁধে হাত রাখলেন। হাসলেন। আমি বললাম, ‘আপনি আমার কাছে একটি মিথিক্যাল কারেক্টার। ছাত্রজীবনে আপনার সঙ্গে একটিবার কথা বলার খুব সাধ ছিল, কিন্তু সাহস ছিল না। সেই সাধ আজ পূরণ হলো। আপনি কি লাতিন ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের নাম শুনেছেন?’

তিনি বললেন, ‘শুনেছি মনে হয়।’ আমি বললাম, ‘তাঁর একটি উপন্যাস আছে গোত্রপিতার হেমন্ত নামে। উপন্যাসটি যখন পড়ছিলাম, সেই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সেই স্বৈরশাসককে মনে হয়েছিল আপনি। যেন আমি আপনার কাহিনিই পড়ছিলাম। আমার খুব ইচ্ছা, আপনাকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখব।’

তিনি আবার হাসলেন। আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন। বললেন, ‘লিখতে পারো, আমার আপত্তি নাই। কোনো তথ্যের প্রয়োজন হলে আমার বাসায় এসো।’

না, তার বাসায় কখনো যাওয়া হয়নি। তার সম্পাদিত পত্রিকা হাজারিকা প্রতিদিনেও কখনো লেখা হয়নি। তারুণ্যে আমি যে ক্লাস কমিটিতে জড়িয়ে পড়েছিলাম, তা নিয়ে আমার কোনো খেদ নেই। অনুতপ্তও নই। কারণ ক্লাস কিমিটিতে জড়িয়ে খারাপ কিছু করিনি। বরং শিখেছি অনেক কিছু, নিয়েছি রাজনীতির প্রথম পাঠ, জেনেছি সন্ত্রাস কাকে বলে। হাজারীর প্রয়াণে সেসব স্মৃতি মনে পড়ে গেল। মনে হলো কিছু লিখি। সেসব স্মৃতি নিয়ে পরবর্তীকালে হয়ত বিস্তারিত লিখব।

জয়নাল হাজারী ছিলেন ফেনীর রাজনীতিবিদ খাজা আহমেদের শিষ্য এবং একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। সেই মুক্তিযোদ্ধার প্রয়াণে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। নবইয়ের দশকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ফেনীর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। ‘গডফাদার’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল তাকে। জীবৎকালে তার কিছু কৃতকর্মের নিন্দা বহুদিন জারি থাকবে। দুষ্কর্মের নিন্দা থাকাটাই স্বাভাবিক।

তবে তিনি আমার কাছে একটি উপন্যাসের কারেক্টার হিসেবেই থাকবেন, যার অঙুলি হেলনে সব কিছু চলত, প্রশাসন যার নির্দেশে সব কিছু করত। কুড়ি বছর আগে যাকে গ্রেপ্তার করতে যৌথ বাহিনী সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছিল, কিন্তু পারেনি। কী কারণে পারেনি, কীভাবে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন―এটা এখনো আমার কাছে বিরাট এক রহস্য, বিরাট এক জিজ্ঞাসা।

একই সঙ্গে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর, স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার আলবদরদের পূণঃউত্থানের কালে জয়নাল হাজারীর মতো ‘গডফাদার’ ও ‘স্বৈরাচারে’র উত্থান স্বাভাবিক ছিল, নাকি অস্বাভাবিক―এটাও একটি জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসার উত্তর কারো কাছে আছে কিনা জানা নেই।

মহাকালে রেখাপাত
২৭ ডিসেম্বর, ২০২১

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments